সরকারদলীয়দের সহায়তায় ধর্ষণে ‘দেড় সেঞ্চুরি’ করে পান্না মাস্টার : অন্যতম হোতা টুটুল এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে

কুষ্টিয়ায় সরকারি দলের গডফাদারদের প্রত্যক্ষ মদতে দেড়শতাধিক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ এবং সেসব কুকর্মের দৃশ্য গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া কুখ্যাত ‘সিরিজ ধর্ষক’ হেলাল উদ্দিন ওরফে পান্না মাস্টার তার কুকীর্তির কথা স্বীকার করেছে। ঘৃণ্য এ কাজে জড়িত অন্য সহযোগীদেরও নাম প্রকাশ করেছে পান্না। গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
এর আগে পান্না মাস্টারকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শিক্ষক নামে এই লম্পটের কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে গ্রেফতার এড়াতে পান্না মাস্টার বেশ কিছুদিন ঢাকায় আত্মগোপনে ছিল।
তবে গণমাধ্যমে প্রকাশের আগে বহু অভিভাবকের আকুতি সত্ত্বেও পান্নাকে গ্রেফতারে কোনো পদক্ষেপ ছিল না প্রশাসনের। যুবলীগের স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় সে ছিল সব ধরনের আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার একাধিক সহযোগীর সবাই স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। পান্না ও তার সহযোগীদের এমন ককুীর্তি ছাড়িয়ে গেছে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে তা উদযাপনকারী ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কুকর্মকেও।
গতকালের ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ার আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষক ছিল এই পান্না মাস্টার। প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে অসংখ্য ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতো। সহযোগীদের সহায়তায় গোপন ক্যামেরায় ধারণ করতো সেই অবৈধ সম্পর্কের দৃশ্য। এরপর ওই ছাত্রী ও পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করতো। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়েছে। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পান্নাকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, পান্না মাস্টারের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত আরও ৩-৪ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ সহায়তা চাইলে করা হবে। গোয়েন্দারা জানান, পান্না মাস্টার ও তার সহযোগীদের কাছে বিভিন্ন ছাত্রীর যৌন সম্পর্কের অসংখ্য ভিডিও চিত্র আছে। সেগুলো উদ্ধার করতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে বলেও জানানো হয়। ইতোমধ্যে কিছু ভিডিও চিত্র উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে পান্নাকে কুষ্টিয়া জেলা ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সূত্রমতে, পান্না মাস্টার কুষ্টিয়া থেকে পালানোর আগে নিজের ব্যবহৃত একটি কম্পিউটার গর্ত করে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই কম্পিউটারে তার অপকর্মের সব তথ্য-প্রমাণ আছে।
এছাড়া তার সহযোগীদের কাছেও অপ্রাপ্ত বয়সী ছাত্রীদের আপত্তিকর ভিডিও আছে; যদিও বেশ কয়েকটি ভিডিও দৃশ্য বাজারে ছেড়ে দিয়েছে দুষ্কৃতিকারীরা। এর আগে গত ৭ জুলাই পান্না মাস্টারসহ চারজনকে আসামি করে কুষ্টিয়া মডেল থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২’র অধীনে মামলা হয়। মামলার অন্য আসামিরা হচ্ছেন প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান ওরফে টুটুল, প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ওরফে সজল ও প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান হাসান। তাদের সবার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। তাদের মধ্যে হাসানুজ্জামানকে ৭ জুলাই কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। আলিমুজ্জামান ও শরিফুল এখনও পলাতক।
অন্যদিকে একই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার যুবলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম ওরফে মনো নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় কুষ্টিয়া গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ পান্নার ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ জব্দ করেছে। ওই ল্যাপটপেও ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করার দৃশ্য ধারণ করা আছে।
এর আগে ঢাকায় অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল কোচিং করানোর নামে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়।
অন্যতম হোতা টুটুল এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে : দেড় শতাধিক ছাত্রীকে বিকৃত যৌন লালসার শিকার বানানোর মূল হোতা পান্না মাস্টার ও প্রকৌশলী টুটুল। পান্না আটক হলেও প্রকৌশলী টুটুল রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে এখনও কুষ্টিয়ায় রয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-প্রধান প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান টুটুল।
কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়াসহ একাধিক ‘রঙমহলে’ নিয়মিত যাতায়াত ছিল প্রকৌশলী টুটুলের। সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন বয়সী মেয়েকে সেসব জায়গায় নেয়া হতো। পরে ওইসব মেয়েকে তার লালসার শিকার বানিয়ে তা গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হতো। জানা গেছে, সর্বশেষ ঘটনা প্রকাশের পর থেকেই টুটুল গাঢাকা দিয়েছে, এমনকি তার মুঠোফোনটিও বন্ধ রয়েছে।
সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার ক’জন শিল্পপতি আর সরকারদলীয় ক্যাডারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণে পুলিশ তার ছায়াটুকুও স্পর্শ করতে পারছে না। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিকদার মশিউর রহমান বলেন, মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে তত্পরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
‘যার কথা মনে পড়তো তার ভিডিও দেখে আনন্দ পেতাম’ : গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার বিকৃত যৌন মানসিকতার বর্ণনা দিয়েছে পান্না মাস্টার। সে বলে, ‘যখন যে ছাত্রীর কথা মনে পড়তো তখন তার ভিডিও ফুটেজ দেখতাম আর আনন্দ পেতাম, আর এ কাজে শুধু আমি যে একাই জড়িত নই তারই প্রমাণ হিসেবে ভিডিও করে রাখি।’
সে গোয়েন্দাদের কাছে বলে, ২০০৬ সাল থেকে সে এই কাজ করে আসছে। বিশেষ করে, মাধ্যমিক পাস মেয়েরাই ছিল তার টার্গেট।