আইয়ুব খানের শাসনামলে সর্বপ্রথম আগরতলা ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়। কথিত আছে, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত অনেকে ভারতের আগরতলায় গিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয় এবং ষড়যন্ত্র কার্যকর করার জন্য তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। এর আগে কখনো বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে বা সাধারণ মানুষের হাতে অবৈধ অস্ত্র ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া খানের শাসনামলেও ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ভারতের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীর অনেকের কাছেই অবৈধ অস্ত্র ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মুজিব বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই অস্ত্র জমা দেয়নি। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে অনেকে ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে লিপ্ত হয়। এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রেও অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা দিতে আসে। তখন থেকে পরীক্ষায় নকল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছোট খাটো বিষয় নিয়েই তারা হত্যাকান্ডে মেতে ওঠতো। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী ছিল জনগণের কাছে আতঙ্কের নাম। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় তারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাত। যাকে তাকে যখন তখন হত্যার হুমকি দিত, এমনকি হত্যা করত। ন্যায়ের শাসন বলতে তখন কিছুই ছিল না। দেশে সৃষ্টি হলো মহা-অরাজকতা। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, গুন্ডামি, দিন দিন বাড়তেই থাকল।
১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই জাতীয় সংসদে দেওয়া তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী- ‘জানুয়ারি ১৯৭২ হতে জুন ১৯৭৩ গুপ্তহত্যার সংখ্যা ২ হাজার ৩৫টি এবং দুষ্কৃতিকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে ৪ হাজার ৯শ’ ২৫ জন।’ যে খবরটি ৭ জুলাই, ১৯৭৩ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়।
ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মুজিববাদ প্রশ্নে ছাত্রলীগের মধ্যে সংকটের সৃষ্টি হলো। ছাত্রলীগে দেখা দিল অনৈক্য। কয়েকদিনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রব সমর্থক ও মাখন সমর্থক ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে শুরু হয় অবৈধ অস্ত্রের মহড়া। প্রায় দিনই দেখা যেত মেধাবী ছাত্রের লাশ। আওয়ামী লীগের একটি অংশ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতা করে জাসদ গঠন করে। তখন বিভিন্ন মিছিলে ছাত্রলীগ ও জাসদ নেতাদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল।
আহমেদ মুসা (ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন), রক্ষীবাহিনী এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙালি যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন।
এ গ্রন্থের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে, ঐ আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ ছিল না।
২ জুন ১৯৭২, সাপ্তাহিক হক কথায় ‘মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এ অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলেও জনৈক এমপির হস্তক্ষেপে এ নরঘাতককে মুক্ত করা হয়েছে।
হায়দার আকবর খান রনো তার (বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা) গ্রন্থে লিখেছেন, মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প বন্ধ করার পর সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়- যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনির ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে তাতে শতাধিক নিহত হয়। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয় এবং তারা তিন দিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হয়।
১৯৭৩ সালে রাশিয়ার একটি হেলিকপ্টার নিয়ে এনএসআইয়ের তৎকালীন পরিচালক নুরুল মোমেন খান (একজন পুলিশ অফিসার) চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বান্দরবানের রুমা থানায় যান। আর্মির পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। তিনি রুমা থানায় গিয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্য মিজোরামের ক্যাপ্টেন গডনারের সঙ্গে একান্তে গোপন বৈঠক করেন। তাদের স্বাধীনতা তরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ প্রদান করার নিশ্চয়তা দেন। এখানে বলা বাহুল্য, আইয়ুব খানের শাসনামলেও মিজোরামের স্বাধীনতাকামীদের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হত।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার দলীয় ক্যাডারদের ভুয়া নামে পিস্তল ও রিভলভারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ওই সব লাইসেন্সধারীর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না এবং লাইসেন্সও নবায়ন হচ্ছে না। বর্তমান মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে আওয়ামী ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বিপুল অস্ত্র ভা-ার গড়ে তুলেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রকাশ্যে তাদের অস্ত্র ব্যবহারের মধ্যদিয়ে। তারা পুলিশের সামনে পিস্তল লোড, অস্ত্র তাক করে গুলিও ছোঁড়ে। পুলিশের সামনে প্রতিপক্ষকে রামদা দিয়ে কোপায়, পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পেটায়- এমন ছবি অহরহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ জন্ম থেকেই গণতন্ত্র ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তাদের ইতিহাস, বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদিদের দল। ডাকাতদের অপরাধ, তারা অন্যের সম্পদ দখলে বা লুণ্ঠনে সন্ত্রাস করে আর ফ্যাসিবাদের ডাকাতি হলো তারা সন্ত্রাসের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই একমাত্র দল যা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকেই দাফন করে এবং প্রতিষ্ঠা করে একদলীয় বাকশালী শাসন।
ইদানিং সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে বিএনপি অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় আসলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে এবং বাড়বে। বিগত দিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে মূলত জঙ্গিবাদের মদদদাতা এবং হোতা হিসেবে আওয়ামী লীগই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অন্য দলগুলো কোন কোন জায়গায় জড়িত ছিল না তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে আওয়ামী লীগের তুলনায় খুবই নগন্য। কারণ এই আওয়ামী লীগের শাসনামলেই যশোর, পল্টন, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জে বোমা বিস্ফোরণে বহু লোক মারা গেছে।
অধিকারের জুন ২০১৩ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, (জানুয়ারি ২০০৯ থেকে মে ২০১৩) মোট খুনের সংখ্যা ১৮ হাজার ২শ’ ৮৯; এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যা ১ হাজার ৮২, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ৬শ’ ৫২, গণপিটুনিতে নিহত ৬শ’ ৩৮ এবং সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ১৭ জন। সুতরাং দেশের জনগণ ঠিকই জানেন, প্রধানত আওয়ামী লীগই এদেশে জঙ্গিবাদের হোতা। অন্যদের দোষারূপ করে কোন লাভ নেই।
লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ভারতের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীর অনেকের কাছেই অবৈধ অস্ত্র ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মুজিব বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই অস্ত্র জমা দেয়নি। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে অনেকে ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে লিপ্ত হয়। এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রেও অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা দিতে আসে। তখন থেকে পরীক্ষায় নকল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছোট খাটো বিষয় নিয়েই তারা হত্যাকান্ডে মেতে ওঠতো। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী ছিল জনগণের কাছে আতঙ্কের নাম। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় তারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাত। যাকে তাকে যখন তখন হত্যার হুমকি দিত, এমনকি হত্যা করত। ন্যায়ের শাসন বলতে তখন কিছুই ছিল না। দেশে সৃষ্টি হলো মহা-অরাজকতা। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, গুন্ডামি, দিন দিন বাড়তেই থাকল।
১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই জাতীয় সংসদে দেওয়া তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী- ‘জানুয়ারি ১৯৭২ হতে জুন ১৯৭৩ গুপ্তহত্যার সংখ্যা ২ হাজার ৩৫টি এবং দুষ্কৃতিকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে ৪ হাজার ৯শ’ ২৫ জন।’ যে খবরটি ৭ জুলাই, ১৯৭৩ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়।
ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মুজিববাদ প্রশ্নে ছাত্রলীগের মধ্যে সংকটের সৃষ্টি হলো। ছাত্রলীগে দেখা দিল অনৈক্য। কয়েকদিনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রব সমর্থক ও মাখন সমর্থক ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে শুরু হয় অবৈধ অস্ত্রের মহড়া। প্রায় দিনই দেখা যেত মেধাবী ছাত্রের লাশ। আওয়ামী লীগের একটি অংশ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতা করে জাসদ গঠন করে। তখন বিভিন্ন মিছিলে ছাত্রলীগ ও জাসদ নেতাদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল।
আহমেদ মুসা (ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন), রক্ষীবাহিনী এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙালি যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন।
এ গ্রন্থের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে, ঐ আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ ছিল না।
২ জুন ১৯৭২, সাপ্তাহিক হক কথায় ‘মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এ অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলেও জনৈক এমপির হস্তক্ষেপে এ নরঘাতককে মুক্ত করা হয়েছে।
হায়দার আকবর খান রনো তার (বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা) গ্রন্থে লিখেছেন, মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প বন্ধ করার পর সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়- যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনির ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে তাতে শতাধিক নিহত হয়। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয় এবং তারা তিন দিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হয়।
১৯৭৩ সালে রাশিয়ার একটি হেলিকপ্টার নিয়ে এনএসআইয়ের তৎকালীন পরিচালক নুরুল মোমেন খান (একজন পুলিশ অফিসার) চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বান্দরবানের রুমা থানায় যান। আর্মির পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। তিনি রুমা থানায় গিয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্য মিজোরামের ক্যাপ্টেন গডনারের সঙ্গে একান্তে গোপন বৈঠক করেন। তাদের স্বাধীনতা তরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ প্রদান করার নিশ্চয়তা দেন। এখানে বলা বাহুল্য, আইয়ুব খানের শাসনামলেও মিজোরামের স্বাধীনতাকামীদের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হত।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার দলীয় ক্যাডারদের ভুয়া নামে পিস্তল ও রিভলভারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ওই সব লাইসেন্সধারীর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না এবং লাইসেন্সও নবায়ন হচ্ছে না। বর্তমান মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে আওয়ামী ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বিপুল অস্ত্র ভা-ার গড়ে তুলেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রকাশ্যে তাদের অস্ত্র ব্যবহারের মধ্যদিয়ে। তারা পুলিশের সামনে পিস্তল লোড, অস্ত্র তাক করে গুলিও ছোঁড়ে। পুলিশের সামনে প্রতিপক্ষকে রামদা দিয়ে কোপায়, পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পেটায়- এমন ছবি অহরহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ জন্ম থেকেই গণতন্ত্র ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তাদের ইতিহাস, বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদিদের দল। ডাকাতদের অপরাধ, তারা অন্যের সম্পদ দখলে বা লুণ্ঠনে সন্ত্রাস করে আর ফ্যাসিবাদের ডাকাতি হলো তারা সন্ত্রাসের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই একমাত্র দল যা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকেই দাফন করে এবং প্রতিষ্ঠা করে একদলীয় বাকশালী শাসন।
ইদানিং সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে বিএনপি অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় আসলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে এবং বাড়বে। বিগত দিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে মূলত জঙ্গিবাদের মদদদাতা এবং হোতা হিসেবে আওয়ামী লীগই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অন্য দলগুলো কোন কোন জায়গায় জড়িত ছিল না তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে আওয়ামী লীগের তুলনায় খুবই নগন্য। কারণ এই আওয়ামী লীগের শাসনামলেই যশোর, পল্টন, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জে বোমা বিস্ফোরণে বহু লোক মারা গেছে।
অধিকারের জুন ২০১৩ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, (জানুয়ারি ২০০৯ থেকে মে ২০১৩) মোট খুনের সংখ্যা ১৮ হাজার ২শ’ ৮৯; এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যা ১ হাজার ৮২, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ৬শ’ ৫২, গণপিটুনিতে নিহত ৬শ’ ৩৮ এবং সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ১৭ জন। সুতরাং দেশের জনগণ ঠিকই জানেন, প্রধানত আওয়ামী লীগই এদেশে জঙ্গিবাদের হোতা। অন্যদের দোষারূপ করে কোন লাভ নেই।
লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি