আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা : এ যেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা

22-08-2013 বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার ভোর রাত্রি পর্যন্ত র‌্যাব, পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পুরো বগুড়া শহর ও আশপাশে অভিযান চালিয়ে ভোরেই নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘বিইএম’ এর ৩ এহসার সদস্য (সুসাইডাল স্কোয়াড মেম্বার)কে গ্রেফতার এবং উদ্ধারকৃত যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।
ভোর সাড়ে ৪টায় র‌্যাব-১২ এর বগুড়া অফিস চত্বরে এই প্রেস ব্রিফিং-এ উপস্থিত ছিলেন, র‌্যাব মিডিয়া উইং এর কমান্ডার হাবিবুর রহমান। সাংবাদিকদের তিনি জানান, বগুড়ায় গ্রেফতাকৃত ৩ জঙ্গি নতুন সংগঠন বিইএম এর  সদস্য। এরা গ্রেফতার না হলে বগুড়ায় মারাত্মক নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশংকা ছিল। এই সময় গ্রেফতারকৃতদের নাম ও পরিচয় জানানো হয়। এরা হলো, বিইএম এর কমান্ডার ফিরোজ আলম (৩৫)। সে দিনাজপুর জেলার বোঁচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ কামিল মাদ্রাসার মাওলানা আফজাল হোসেনের পুত্র। এছাড়াও অপর দু’জন এহসার সদস্য ঢাকার কমলাপুর রেল কলোনী এলাকার মিজানের পুত্র নাহিদ (২২) ও এহসার সদস্য গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সোনারপাড়া গ্রামের মো. মুকুরূপ শেখের পুত্র বারহা শেখ বাবু (২২)।  তাদের কাছে যে সব অস্ত্র পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি এসএমজি ১৫ রাউন্ড গুলি ভর্তি ম্যাগজিন, একটি জার্মান স্পোর্ট রাইফেল ও ৮ রাউন্ড গুলি ভর্তি ম্যাগজিন, একটি গোলাকার ৩৫ রাউন্ড গুলিসহ ড্রাম ম্যাগজিন, একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ আমেরিকান পিস্তল ও ৮ রাউন্ড গুলি ভর্তি ম্যাগজিন। এছাড়াও ১২ ইঞ্চি তিনটি চাকু, একটি ৮ ইঞ্চি চাকু, একটি ১৩ ইঞ্চি চাকু, একটি দু’ধারা ড্রেগার এবং কয়েকটি চাইনিজ কুড়াল। এছাড়াও কয়েকটি স্কুল ব্যাগ, হিসনুল মুসলিম বই, ইসলামী জ্ঞানকোষ বই, মুনজাযাহ বই, যুগে যুগে শয়তানের হামলা বই, জিহাদী বিষয়ক মৌলিক আলোচনা বই, ফায়ার আর্মড বই, আল্ল¬াহর উপর তাওয়াককুলসহ বেশ কিছু ডায়েরী, বিভিন্ন সাংকেতিক নকশাসহ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। 
এই প্রেস ব্রিফিং-এ গ্রেফতার অভিযানকালে জঙ্গি সদস্যদের হাতে আহত র‌্যাব সদস্যদের নাম  জানানো হয়। এরা হলেন, র‌্যাব-১২ এর ডিএডি আনিছ, কর্পোরাল মতিয়ার ও জীবন এবং এএসআই বিজীত। প্রেস ব্রিফিং-এ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, সম্ভবত সাবেক জেএমবি’র সদস্যরাই বিইএম নামে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। তবে বিইএম এর নামের এ্যাভ্রিভিয়েশন তারাও জানতে পারেননি। সারারাত চেষ্টা করেও গ্রেফতাকৃতদের কাছ থেকে তাদের সংগঠন ও নাশকতার ছক সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। গতকাল দুপুরের পর গ্রেফতারকৃতদের বগুড়া সদর থানায় হস্তান্তর করা হলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধাদান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রাখার পৃথক তিনটি অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় এই খবর লেখার সময় পর্যন্ত পুলিশ তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। 
এদিকে গতকাল শুক্রবার বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া ইয়াছিন নগরের যে বাসা থেকে জঙ্গিদের গ্রেফতার করা হয় সেই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এলাকাটি বগুড়া পৌরসভার সম্প্রসারিত ১২ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হলেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই। এলাকাটি কিছুদিন আগেও খানা খন্দকে ভরা থাকলেও সম্প্রতি সেখানে এলোমেলোভাবে পাকা বিল্ডিং ও সেমি পাকা টিন শেডের অনেক নতুন নতুন বাড়ি ঘর হয়েছে। রাস্তা ঘাট তেমন না থাকায় এখনও এলাকাটি শহরবাসীর কাছে দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত। ফলে এখানে মূল শহরের তুলনায় বাড়ি ভাড়া অনেক কম। ফলে অসংখ্য বে-সরকারি ছাত্রাবাস, কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে অপরাধ করার সুযোগ থাকায় এই এলাকাটিকেই সমাজ বিরোধীরা সেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সঙ্গত কারণেই এই এলাকায় দীর্ঘদিন স্ব-পরিবারে আত্মগোপন করেছিলেন, জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা ও আধাত্মিক নেতা শায়খ আব্দুর রহমান। এই বাসাতেই পলাতক অবস্থায় শায়খ রহমানের কন্যা সন্তান প্রসব করেন। পরবর্তীতে শায়খ রহমানের জামাতা আব্দুল আওয়াল পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বগুড়ায় দীর্ঘ দিন আত্মগোপনে থাকার ঘটনাটি জানাজানি হয়ে পড়ে। ঠনঠনিয়া ইয়াছিন নগর নামক এই এলাকায় যে বাসাটি বিইএম এর ১৫ জন সদস্য সরকারি আযিযুল হক কলেজের ছাত্র পরিচয়ে কোচিং সেন্টার পরিচালনার নাম করে ভাড়া নেয় সেই বাড়ির মালিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল হোসেন। দুলাল হোসেন তাদেরকে গ্রেফতার হওয়ার ৪ দিন আগে ৫শ’ টাকা অগ্রীমসহ মাসিক চার হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছিলেন। তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে তার ভাড়া বাসায় র‌্যাবের অভিযানের পর থেকে আত্মগোপন করেছেন এবং তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ করে রেখেছেন। ফলে র‌্যাব কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছেন না। গতকাল শুক্রবার তার স্ত্রী নাদিরা বেগম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ঝামেলার ভয়ে দুলাল হোসেন মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। তার স্বামী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। নিজে ছোটখাট ঠিকাদারী করেন এবং বগুড়া জেলা যুবলীগ সভাপতির ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের একজন সাইট ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেন। জেনেশুনে তিনি জঙ্গিদের বাড়ি ভাড়া দেননি। উল্লে¬খ্য, দুলাল হোসেনের মালিকানাধিন এই বাড়িটি থেকেই কিছুদিন আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করেছিল। তারও আগে নারী ঘটিত কারবারের কারণে বাড়িটিতে পুলিশি অভিযান হয়েছিল বলে এলাকাবাসী জানান। একটি সূত্র জানিয়েছে জঙ্গিরাও সম্ভবত বুঝেশুনেই বাড়িটি ভাড়ার জন্য নির্বাচিত করেছিল এই ভেবে যে আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ভাড়া নিলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির বাইরে থাকতে সুবিধা হবে এ যেন অনেকটা বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার অবস্থা!