আইজির বক্তব্য অসত্য ও বিভ্রান্তিকর ৫ মের গণহত্যা নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করা হচ্ছে

চট্টগ্রাম ব্যুরো
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গতকাল শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে গত ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে যৌথবাহিনীর গণহত্যা নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যকে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, ৫ মে গণহত্যায় হতাহতের ঘটনা নিয়ে জনসাধারণের মাঝে যে সংশয় ও বিভ্রান্তি রয়েছে তা সমাধানের জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনা ও হতাহতের সঠিক তথ্য দেশবাসী ও বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন না করে গোয়েবলসীয় কায়দায় হেফাজতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অসত্য ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ কতিপয় মন্ত্রী-এমপি ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা শাপলা চত্বরের সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে নিয়মিত মিথ্যাচার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার আরেকটি নজির স্থাপন করলেন। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। ৫ মে গভীর রাতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে মিডিয়াকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে জিকিররত, ঘুমন্ত ও তাহাজ্জুদগোজার আলেম-হাফেজ ও নবীপ্রেমিক তৌহিদি জনতার ওপর যৌথবাহিনীর মাধ্যমে যে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে প্রকৃত ঘটনা জানানো। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন সেই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বরং মিথ্যা মামলা দিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। গ্রেফতার-নির্যাতন চালিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার চক্রান্ত হিসেবে ইসলামি দলগুলোকে টার্গেট করে ইহুদি, সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীলনকশা তৈরি করা হচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, দেশ থেকে ইসলামি শিক্ষা মুছে দেয়ার লক্ষ্যে কুরআন ও হাদিসের চর্চা বন্ধ করে দেয়ার জন্য এবং সর্বোপরি ইসলামি মূল্যবোধ, আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিকতা ধ্বংস করার বহুমুখী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে সরকার ও প্রশাসনের অতিউৎসাহী দালাল কর্মকর্তারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। আইজি শহিদুল হক বলেছেন হেফাজতের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ নাকি হেফাজতের হাতে নেই। আমাদের কথা হচ্ছে, যদি হেফাজতের হাতে হেফাজতের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণই না থাকে তাহলে দেশব্যাপী নিরীহ আলেম-ওলামাদের ওপর মামলা ও হয়রানি কেন? সম্প্রতি দেশের একজন বর্ষীয়ান আলেম সাবেক এমপি মুফতি ওয়াক্কাসকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার চক্রান্ত করছে। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজির কাছে আমাদের প্রশ্ন হেফাজতে ইসলামকে একরাত অবস্থান করতে দেয়া হলো না; অথচ কতিপয় শাহবাগী নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগারদের তিন মাস ধরে রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে হাসপাতালের রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলে যারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, যারা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর শানে কটূক্তি ও বেয়াদবি করেছে; সর্বোপরি নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণক্ষেত্র তৈরি এবং মাদকের রমরমা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে পুরো জাতিকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাদেরকে কোন্ আইনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রেখে নিরাপদে অবস্থান করতে দেয়া হলো। তাহলে কি দেশবাসী বুঝে নেবে যে মতিঝিলে আগত লাখ লাখ মানুষকে এ দেশের নাগরিক মনে করা হয়নি? পত্রিকার খবরে প্রকাশিত দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে হাজার হাজার আলেমকে শহীদ ও আহত করা হয়েছে, তা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? শাহবাগীদের জামাই-আদর, আর হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বর্বরোচিত আক্রমণ সরকার ও প্রশাসনের দ্বিমুখী নীতি নয় কী? হেফাজত নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ১০ হাজারেরও বেশি আলেম-হাফেজ ও তৌহিদি মানুষ ৫ মে রাতে যৌথবাহিনীর আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেড় হাজারের অধিক আহত হেফাজত নেতাকর্মী ও সমর্থক চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বহু লোক চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। বহু লোক অন্ধ ও বধির হয়ে গেছেন। ভারপ্রাপ্ত আইজিপি মহোদয় কি জবাব দেবেন আর কত গোলাবরুদ ব্যবহার করলে, আর কিরূপ জঘন্যভাবে আক্রমণ করলে এত লোক তিন-চার মাস যাবত হাসপাতালে, বিছানায় শুয়ে ব্যথায়-বেদনায় কাতরায়? আইজি মহোদয় কি জবাব দেবেন যে শত শত আলেমের লাশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাফন করা হয়েছে, এই লাশগুলো কোত্থেকে এলো? পুলিশ যদি সত্যিই জনগণের সেবক হয়ে থাকে তাহলে শাপলা চত্বরের শহীদদের নামাজে জানাজা কেন তাদের নিজ নিজ এলাকায় বা গ্রামে প্রকাশ্যে পড়তে দেয়া হলো না? পুলিশ কেন বাধার সৃষ্টি করলো? শহীদ পরিবারকে কেন ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে নানা দিক থেকে? তদন্ত করে দেখা কি আপনাদের দায়িত্ব ছিল না? সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত আইজির হেফাজতের নেতাকর্মীরা কুরআন শরীফ ও ব্যাংকের বুথে আগুন দেয় মর্মে বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করে হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে আওয়ামী লীগ তাদের সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী দিয়ে কুরআন শরীফ পুড়িয়েছে, মসজিদে আগুন দিয়েছে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে এদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার না করার অর্থ হলো, মূলত হেফাজতকর্মীরা নয়, সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররাই যে ধরা পড়বেন, তাই কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। গোলাপ শাহ মাজার এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপরে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলি ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের কর্মীদের ধরে নিয়ে জবাই করা হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রহস্যজনকভাবে নির্বিকার ও নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতনভুক্ত প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরকারদলীয় ক্যাডারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায়। পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোনো দলের ক্যাডার নন। আপনাদের নিরপেক্ষ ভূমিকাই দেশবাসী আশা করে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না। হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। এ দেশে সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। হজরত মুহাম্মদ সা: আমাদের প্রিয়নবী। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর শানে আল্লাহর জমিনে কেউ বেয়াদবি করলে আমরা তাঁর গোলাম হিসেবে বরদাশত করতে পারি না। আলেমসমাজ আম্বিয়ায়ে কেরামের ওয়ারিশ। তা ছাড়া এ দেশের নাগরিক হিসেবে যেকোনো ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অন্যায়, অনাচার, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব। হুমকি ধমকি দিয়ে ও মামলা-হামলা চালিয়ে হেফাজতের ঈমানি আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। যারা ৫ মে গণহত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছে, যারা আক্রমণ করেছে, সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, মহান আল্লাহর ওয়াদা হলো, তাঁকে কেউ গালি দিলে বা কটূক্তি করলে আল্লাহ সহ্য করেন; কিন্তু তাঁর প্রিয় হাবিব বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শানে কিঞ্চিৎ বেয়াদবি ও কটূক্তি করলে এবং এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আল্লাহ সহ্য করেন না। এদেরকে ফেরাউন-নমরুদ-আবু জেহেল-ওৎবা-শায়বাদের মতো নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হবে। তারা আরো বলেন, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও আলেমসমাজ এ দেশের নির্ভেজাল খাঁটি দেশপ্রেমিক নাগরিক, কোনো অনৈতিক ও অন্যায় কাজে জড়িত থাকার কোনো উল্লেখযোগ্য রেকর্ড নেই। আলেমদের সাথে বেয়াদবি ও গাদ্দারির পরিণাম কারো জন্যই শুভ হবে না। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ৫ মে’র বর্বরোচিত ঘটনার পর আমাদের আমির আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশে চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছি। কোনো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আমরা নতুন করে দেশে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হোক তা চাইনি। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরা বারবার উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, হেফাজতের আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। হেফাজতের ১৩ দফা নিতান্তই ঈমানি দাবি। ক্ষমতার মোহ আমাদের নেই। কিন্তু ঈমান ও আকিদার প্রশ্নে কোনো আপসও নেই। পৃথিবীর যত মহাশক্তিই হোক না কেন, আল্লাহ যখন ধরবেন তখন কারোরই নিস্তার নেই। সংবাদপত্রে প্রেরিত বিবৃতিদাতারা হলেনÑ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির আল্লামা শামসুল আলম, আল্লামা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ, আল্লামা শায়েখ আবদুল মোমেন খলিফায়ে মাদানী, আল্লামা নূর হোসেন কাসেমী, আল্লামা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, আল্লামা আবদুল মালেক হালিম, আল্লামা আবদুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, আল্লামা হাফেজ আনোয়ার শাহ, আল্লামা আশরাফ আলী বিজয়পুরী প্রমুখ।