আলেমদের সঙ্গে গাদ্দারির পরিণাম শুভ হবে না : হেফাজতে ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত আইজিপির বক্তব্য গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচারের আরেকটি নজির হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি

প্রধানমন্ত্রীসহ কিছু মন্ত্রী-এমপি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে নিয়মিত মিথ্যাচার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে
বিভ্রান্ত করার আরেকটি নজির স্থাপন করেছেন বলে দাবি করেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। 
বিবৃতিতে ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানকে ‘গণহত্যা’ উল্লেখ করে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি একেএম শহীদুল হকের বক্তব্যকে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর দাবি করে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা তার ওই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। 
হেফাজত নেতাকর্মীরা কোরআন শরিফ ও ব্যাংকের বুথে আগুন দেয় মর্মে ভারপ্রাপ্ত আইজিপি বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হেফাজত নেতারা অভিযোগ করেন, বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে আওয়ামী লীগই তাদের সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী দিয়ে কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে, মসজিদে আগুন দিয়েছে। কর্মীদের ধরে নিয়ে জবাই করেছে। বিবৃতিতে তারা ‘ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার চক্রান্ত হিসেবে ইসলামী দলগুলোকে টার্গেট করে ইহুদি, সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীলনকশা তৈরি করা হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ করেন। 
গতকাল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা হাফেজ মোজাম্মেল হকের পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে দলের শীর্ষ নেতারা এ দাবি করেন।
হেফাজতের শীর্ষ নেতারা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও আলেম সমাজ এদেশের নির্ভেজাল খাঁটি দেশপ্রেমিক নাগরিক। কোনো অনৈতিক ও অন্যায় কাজে জড়িত থাকার কোনো উল্লেখযোগ্য রেকর্ড নেই। আলেমদের সঙ্গে বেয়াদবি ও গাদ্দারির পরিণাম কারও জন্যই শুভ হবে না। 
বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা একই সঙ্গে ‘দেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা মুছে দেয়ার লক্ষ্যে কোরআন-হাদিসের চর্চা বন্ধ করে দেয়ার জন্য এবং সর্বোপরি ইসলামী মূল্যবোধ, আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিকতা ধক্ষংস করার বহুমুখী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে সরকার ও প্রশাসনের অতি উত্সাহী দালাল কর্মকর্তারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে’ বলে দাবি করেন। 
বিবৃতিতে তারা বলেন, ৫ মে গণহত্যায় হতাহতের ঘটনা নিয়ে জনসাধারণের মাঝে যে সংশয় ও বিভ্রান্তি রয়েছে তার সমাধানের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার তা না করে ভিন্ন কায়দায় হেফাজতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অসত্য ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে। 
হেফাজত নেতারা বলেন, ৫ মে গভীর রাতে বিদ্যুত্ বিচ্ছিন্ন করে মিডিয়া কর্মীদের সরিয়ে দিয়ে জিকিররত, ঘুমন্ত ও তাহাজ্জুত গোজার আলেম-হাফেজ ও নবীপ্রেমিক তৌহিদি জনতার ওপর যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে যে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া এবং দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক বিশ্বকে প্রকৃত ঘটনা জানানো। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন সেই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং মিথ্যা মামলা দিয়ে হেফাজত নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। 
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি শহীদুল হক বলেছেন, হেফাজত নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ নাকি হেফাজতের হাতে নেই। একথা সঠিক নয়। হেফাজত নেতাদের নেতৃত্ব না থাকলে এতো বড় সমাবেশ করা সম্ভব হতো না। 
হেফাজতে ইসলাম নেতারা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজির কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, হেফাজতে ইসলামকে একরাত অবস্থান করতে দেয়া হলো না; অথচ কিছু শাহবাগি নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগার তিন মাস ধরে রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। হাসপাতালের রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। যারা মহান আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) শানে কটূক্তি ও বেয়াদবি করেছে; সর্বোপরি নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি এবং মাদকের রমরমা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে পুরো জাতিকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাদেরকে কোনো আইনে তিন-স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রেখে নিরাপদে অবস্থান করতে দেয়া হলো। তাহলে কী দেশবাসী বুঝে নেবে, মতিঝিলে আগত লাখ লাখ জনতাকে এদেশের নাগরিক মনে করা হয়নি? 
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, পত্রিকার খবরে প্রকাশিত দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা ও আহত করা হয়েছে। এটা কী মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? শাহবাগিদের জামাই-আদর আর হেফাজত নেতাকর্মীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ সরকার ও প্রশাসনের দ্বিমুখী নীতি নয় কী? 
তারা বলেন, প্রায় ১০ হাজারের বেশি আলেম-হাফেজ ও তৌহিদি জনতা ৫ মে রাতে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় দেড় হাজারের অধিক আহত হেফাজত নেতাকর্মী ও সমর্থক চিকিত্সাধীন রয়েছেন। বহু লোক চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। বহু লোক অন্ধ ও বধির হয়ে গেছেন। আইজিপি কী জবাব দেবেন কত গোলাবরুদ ব্যবহার করলে, আর কেমন জঘন্যতম আক্রমণ করলে এত লোক তিন চার মাস ধরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ব্যথা বেদনায় কাতরায়? আইজিপি কী জবাব দেবেন শত শত আলেমের লাশ যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাফন করা হয়েছে—এই লাশগুলো কোত্থেকে এলো? 
বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা ভারপ্রাপ্ত আইজিপির কাছে আরও প্রশ্ন রাখেন, পুলিশ যদি সত্যিই জনগণের সেবক হয়ে থাকে তাহলে শাপলা চত্বরে শহীদদের জানাজা নামাজ কেন তাদের নিজ নিজ এলাকায় বা গ্রামে প্রকাশ্যে পড়তে দেয়া হলো না? পুলিশ কেন বাধার সৃষ্টি করল? শহীদদের পরিবারকে কেন ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে নানাদিক থেকে? তদন্ত করে দেখা কী আপনাদের দায়িত্ব ছিল না? 
তারা বলেন, ৫ মে’র অভিযান নিয়ে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ভিডিও ফুটেজ দেখে (কোরআন শরিফ পোড়ানো ও মসজিদে আগুন দেয়া ব্যক্তিদের) গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার না করার অর্থ হলো, মূলত হেফাজত কর্মীরা নয়, সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররাই এ কাজ করেছে। তাই কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, গোলাপ শাহ মাজার এলাকায় হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলি ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের কর্মীদের ধরে নিয়ে জবাই করা হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রহস্যজনকভাবে নির্বিকার ও নীরব ভূমিকা পালন করেছে। 
বিবৃতিতে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা বলেন, পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোনো দলের ক্যাডার নন। আপনাদের নিরপেক্ষ ভূমিকাই দেশবাসী আশা করেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না। 
হেফাজত নেতারা বলেন, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। এদেশে সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। হজরত মোহাম্মদ (সা.) আমাদের প্রিয়নবী। আল্লাহ তাঁর রাসুলের (সা.) শানে আল্লাহর জমিনে কেউ বেয়াদবি করলে আমরা তার গোলাম হিসেবে বরদাশত করতে পারি না। আলেমসমাজ আম্বিয়ায়ে কেরামের ওয়ারিশ। তাছাড়া এদেশের নাগরিক হিসেবে যে কোনো ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অন্যায়, অনাচার, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব। হুমকি-ধমকি দিয়ে ও মামলা-হামলা চালিয়ে হেফাজতের ঈমানি আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। যারা ৫ মে গণহত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছে, যারা আক্রমণ করেছে, সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 
তারা আরও বলেন, মহান আল্লাহর ওয়াদা হলো, তাঁকে কেউ গালি দিলে বা কটূক্তি করলে আল্লাহ সহ্য করেন, কিন্তু তাঁর প্রিয় হাবিব বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শানে কিঞ্চিত্ বেয়াদবি ও কটূক্তি করলে এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আল্লাহ সহ্য করেন না। তাদের ফেরাউন-নমরুদ-আবু জেহেল-ওত্বা-শাইবাদের মতো নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ৫ মে’র বর্বরোচিত ঘটনার পর আমাদের আমির আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশে চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছি। কোনো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আমরা নতুন করে দেশে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, তা চাইনি। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরা বারবার উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, হেফাজতের আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। হেফাজতের তেরো দফা নিতান্তই ঈমানি দাবি। ক্ষমতার মোহ আমাদের নেই। কিন্তু ঈমান ও আকিদার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। পৃথিবীর যত মহাশক্তিই হোক না কেন, আল্লাহ যখন ধরবেন তখন কারোরই নিস্তার নেই। 
বিবৃতিদাতারা হলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির আল্লামা শামসুল আলম, আল্লামা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ, আল্লামা শায়েখ আবদুল মোমেন খলিফায়ে মাদানী, আল্লামা নূর হোসেন কাছেমী, আল্লামা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, আল্লামা আবদুল মালেক হালিম, আল্লামা আবদুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, আল্লামা হাফেজ আনোয়ার শাহ ও আল্লামা আশরাফ আলী বিজয়পুরী প্রমুখ। 
প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এবং ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ঝাড়েন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি একেএম শহীদুল হক।
এতে তিনি বলেন, তারা (হেফাজত নেতারা) বলেছিল, তারা কোনো অরাজকতা (মতিঝিলের সমাবেশে) করবে না। কিন্তু তারা কথা রাখেনি, মোনাফেকি করেছে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রাণঘাতী নয়, এমন মারণাস্ত্র (নন-লেথাল উইপন) ব্যবহার করে এ অভিযান চালানো হয়েছে, যাতে একজন মানুষেরও কোনো ক্ষতি না হয়। আপনারা দেখেন, মিসরে কীভাবে সেনাবাহিনী মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। আমাদের এখানে সে রকম কিছু হয়নি।
‘ওই রাতের অভিযানে কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি’ দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শাপলা চত্বরের অভিযান শেষে আগেই মারা যাওয়া চারজনের কাফন পরানো মৃতদেহ উদ্ধার করা ছাড়া আর কোনো মৃতদেহ উদ্ধার হয়নি। এর পরও একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমাবেশে গণহত্যার কথা প্রচার করা হচ্ছে। 
এতে তিনি ‘একটি তথ্যও মিথ্যা বলব না। আমি রাজনীতি করি না’ দাবি করে অভিযান নিয়ে ‘মিথ্যাচার’ বন্ধ না করলে দেশের প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।