জান্নাতের পথে আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদ রহ.
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যৌবনের গান প্রবন্ধে যুবকের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, প্রায় একশ বছর বয়স্ক আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদ রহ. ছিলেন তারই নিখুঁত রূপ। তার ভেতরে ঢাকা ছিল যৌবনের তেজস্বী সূর্য। জীবন সায়াহ্নেও বার্ধক্য তাঁর মানসকে স্পর্শ করেনি; আঁচড় লাগাতে পারেনি তাঁর মন-মননে। কাজের গতিশীলতা, চিন্তার প্রখরতা ও চিত্তের উত্তাপে টগবগে যুবাকেও তিনি হার মানাতেন। গত ১২ই ফেব্রুয়ারী ১৩ ইং রোজ মঙ্গলবার সকাল ৯.৩৫ মিনিটে তিনি মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদেরকে এতিম করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। এ মুহূর্তে স্মৃতিপটে শুধুই ভেসে উঠছে হাসান বসরী রহ.-এর ঐতিহাসিক উক্তি, একজন আলেমের মৃত্যু ইসলামের জন্য ছিদ্রস্বরূপ, যার পূর্ণতা কিয়ামত পর্যন্ত অন্য কোন বস্তু দ্বারা সাধিত হয় না। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৩ বছর। তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র-ভক্ত রেখে গেছেন।
দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদীস আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদের মৃত্যু নিছক এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, ইসলামি জ্ঞানের এক বিশ্বকোষের যেন দুঃখজনক ইতি। তিনি ছিলেন ইসলামি ইনসাইক্লোপেডিয়াতুল্য আলেমে দ্বীন। উর্দূ, ফার্সি ও আরবি সাহিত্যে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। ধর্মতত্ত¡, হাদীসশাস্ত্র, অলংকারশাস্ত্র, আরবি ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রবাদতুল্য। ইসলামি কিতাব পত্রের আঁকে-বাঁকে স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণের ফলে তাঁর মস্তিষ‹ ছিল ইলমে নববির বি¯তৃত ও সমৃদ্ধ ভাণ্ডার।
আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদ ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জনাব আলী মিয়া সওদাগর। নাজিরহাট মাদরাসাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। অতঃপর হাটহাজারী মাদরাসায় শরহে বেকায়া জামাতে ভর্তি হয়ে মাত্র তিন মাস সেখানে শিক্ষা অর্জন করেন। ইতিমধ্যে সেখানে একটি গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি আবার নাজিরহাটে বর্ষপূর্ণ করেন। এরপর “আযহারুল হিন্দ দারুল উলুম দেওবন্দে” ভর্তি হয়ে সেখানে পাঁচ বছর অবস্থান করেন। দেওবন্দে তিনি দাওরায়ে হাদীসে (সমাপনী বর্ষে) হাদীসের বিখ্যাত বিশুদ্ধ ছয় গ্রন্থ, তাফসীর এবং উচ্চতর হাদীসের জ্ঞান অর্জন করেন। দেওবন্দে তিনি ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনের অগ্রসেনানী, আওলাদে রাসূল স. সায়্যিদ আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর সান্নিধ্যে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করেন। মাদানী রহ.-এর প্রভাব তাঁর জীবনে তীব্রভাবে অনুভূত হতো। “ফাযায়েলে আমালের” লেখক, শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. থেকেও তিনি হাদীসের ইজাযত (অনুমতি) লাভ করেন। তিনিই ছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি একই সাথে এই দুই মহা মনীষীর কাছ থেকে হাদীসের ইজাযত লাভ করেছিলেন। দেওবন্দে তিনি অন্য যাদের কাছে পড়েছেন, শায়খুল আদব মাও. এ’জাজ আলী, মাও. ইবরাহীম বলিয়াভি রহ.। ইলমে জাহেরীর সাথে সাথে ইলমে বাতেনী তথা তাসাউফ-সুলুকের রাজপথেও ছিল তাঁর সরব পদচারণা। পাকিস্তানের বিখ্যাত বুযুর্গ আল্লামা হাকীম আখতার দা.বা.-এর খেলাফত লাভেও ধন্য হন তিনি। দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর শিক্ষকতা দিয়েই প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। নাজিরহাট মাদরাসা তার প্রথম কর্মস্থল। সেখানে ৪ বছর শিক্ষকতার পর বাবুনগর মাদরাসায় উচ্চতর বিভিন্ন জ্ঞান ও শাস্ত্রের উপর দরস প্রদান করেন। তখন তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এক বছর বাড়ীতে অবসর কাটান। এরপর ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু প্রায় ৪৮ বছর জামিয়ার শিক্ষকতার মহান খিদমত আঞ্জাম দেন। পটিয়া মাদরাসায় তিনি হাদীসের প্রায় সকল গ্রন্থই নিপুণভাবে পাঠদান করেন। তাঁর ছাত্রদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ধারণা করা হয়, তাঁর ছাত্রসংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তার সান্নিধ্যে হাজার-হাজার মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, মুফতি, আদর্শবান লেখক, বক্তা ও রাজনীতিবিদ তৈরী হয়েছেন। যারা দেশে-বিদেশে সর্বত্র দ্বীনের বহুমুখী সেবায় রত রয়েছেন। শেষদিকে এসে তিনি জামিয়ার শায়খুল হাদীসের পদ অলংকৃত করেন। তিরমিযি ২য় খণ্ডের অনবদ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ “লুবাবুন নুকুল” ও “শরহে জামীর” ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আল-ফরাইদুদ দিরাসীয়্যা” তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠকর্ম। এছাড়াও “ইরশাদুস সালেকীন”, “শরহে ক্বালা আবু দাউদ” ও “মবহাছুল ইমান ওয়াল মেরাজ” তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।তাঁর জীবনে বহুমাত্রিক প্রতিভা প্রতিভাত হয়ে ওঠে। যথা, তাফসীর হযরতের বরকতপূর্ণ স্বভাব, ফিক্হ তাঁর সহজাত চরিত্র, তাজবীদ হযরতের হৃদয়প্রফুল্ল সুর, নাহু ও ছরফ হযরতের সাহিত্যিক ভাষা, সাহিত্য মরহুমের দ্বিতীয় স্বভাব আর হাদীস হযরতের মহান আদর্শ।
ব্যক্তি জদীদ সাহেব রহ. ছিলেন অপূর্ব, উদার ও অমায়িক এক মানুষ। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যে কোন মানুষকে সহজে কাছে টানত। তাঁর অন্তর যেন মমতার এক সাগর। তাঁর রাগ, ভর্ৎসনা ও ধমকে ঝরে পড়ত মায়া। তার নগণ্য ছাত্র হিসেবে দীর্ঘদিন তাঁকে আমি নিবিড়ভাবে দেখেছি। আমি হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও নীচুতা তাঁর মাঝে অনুভব করিনি। আমার কাছে মনে হত, তাঁর অন্তর যেন এক ধবধবে কাঁচের টুকরা, যেখানে পংকিলতার কোন দাগ নেই, হীনমন্যতার কোন কালিমা নেই। মানবতাবোধ, উদার চিন্তা, অকৃত্রিম মমতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে করেছে সুমহান। সরলতা ছিল হুজুরের অনন্য গুণ। তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই সাদাসিধে, অনাড়ম্বর। সুন্নাতে রাসূলের পাবন্দী ছিল তাঁর জীবনের পরতে-পরতে। আধ্যাত্ম সাধনা, জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। জাতীয় সমস্যা-সংকট সম্পর্কে তিনি ভাবতেন। মুসলিম উম্মাহর পতন, ইরাক-ফিলিস্তিনের কান্না, আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদের থাবা এবং দেশে-দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাঁকে অস্থির করে তুলত। ইলমে দ্বীনের এ মহান নীরব সাধক প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল জ্ঞানপিপাসুদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করেছিলেন। ইলম পিপাসায় কাতর কোন ব্যক্তি যখন তাঁর সাহচর্যে যেতেন, তিনি তৃপ্ত হয়েই ফিরতেন। তাঁর কথা ছিল জ্ঞানদীপ্ত, গভীরতানির্ভর ও দলিলভিত্তিক।
হুজুর ইন্তেকাল করেন সকাল ৯.৩৫ মিনিটে। হুজুরের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে-সাথে জামিয়া লোকে লোকারণ্য হতে থাকে। মাগরিবের পর জামিয়ায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের নেতাকর্মীগণ, সকল মতের উলামা-মাশায়েখের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ এমন বিশাল জানাযার নামাজ সচরাচর দেখা যায় না। পুরো জামিয়া লোকে লোকারণ্য, কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে হুজুরের সুযোগ্য সাহেবজাদা, জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র শিক্ষক হাফেয যাকারিয়া আল-আযহারী জানাযার নামাজে ইমামতি করেন। এরপর তাঁকে তাঁর আকাবিরদের পাশে ‘মাকবারায়ে আযীযে” দাফন করা হয়। বাংলাদেশ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হারিয়েছে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, বাংলার বাঘ মুফতি ফজলুল হক আমিনী, আল্লামা ইসহাক গাজী, আল্লামা নুরুল ইসলাম ক্বদীম, আল্লামা শাহ আইয়ুব রহ. প্রমূখ প্রতিথযশা ব্যক্তিদের। ধারাবাহিক সেই মৃত্যুর মিছিলে সবশেষে যুক্ত হলেন আকাবিরদের মূর্ত প্রতিচ্ছবি, সদা হাস্যোজ্জ্বল নূরানী চেহারার অধিকারী, বৃটিশ-পাক-বাংলা আমলের অসংখ্য উত্থান-পতনের প্রত্যক্ষদর্শী, জীবন্ত ইসলামি বিশ্বকোষ শায়খুল হাদীস আল্লামা ক্বারী নুরুল ইসলাম জদীদ রহ.।;উত্তরসূরীদের সামনের খোলা পথে ঘোর অমানিশার হাতছানি ,এক-এক করে নিভে যাচ্ছে প্রদীপ; পরপারের যাত্রীদের কাফেলা হচ্ছে ভারী। যাঁরা বিদায় হয়ে যাচ্ছেন তাঁদের আসন পূরণ হবে কিনা জানিনা। জদীদ সাহেব হুজুরকে হারানোর বেদনায় অস্থির হাজার-হাজার ওলামা-মাশায়েখ ও অসংখ্য গুণগ্রাহী আমজনতা।
পরিশেষে, হে আল্লাহ! হে মহামহিম! আপনার এই প্রিয় বান্দাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন! আপনারই এক প্রিয় বান্দার ভাষায় বলব, আকাশ যেন তাঁদের সমাধিতে শিশির করে বর্ষণ সেই ঘরের যেন যতœ করে চিরকাল সবুজের আবরণ! আমরা মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাচ্ছি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলের সহায় হোন। আমীন। লেখক : ছাত্র, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পটিয়া চট্টগ্রাম।