*হেফাজত নেতাদের চাপে রাখার কৌশল
রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে যোগদানকারী তৌহিদি জনতাকে সরানোর পর এবার হেফাজত নেতাদের চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আদেশ চেয়ে হাইকোটে রিট, রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য হত্যামামলা দায়ের করা হয়েছে। হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে ৯ দিনের রিমান্ডে নেয়া এবং অন্য নেতাদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করাও তার অংশ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
হেফাজত সংশ্লিষ্টদের মতে, ৫ মে রাতে যৌথ অভিযানে হেফাজতের অসংখ্য নেতাকর্মী হতাহত হওয়ার প্রতিবাদে বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়া থেকে হেফাজত নেতাদের বিরত রাখাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ভবিষ্যতে যাতে ১৩ দফা দাবিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে এমন কোনো কর্মসূচি থেকে দূরে রাখাও চাপ প্রয়োগের অন্যতম কৌশল।
হেফাজতের সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ৬ মে লালবাগ মাদরাসা ঘেরাও করে দীর্ঘ সময় মাদরাসার ভেতর পুলিশের অবস্থান, আল্লামা শফী বা হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরী নেতাদের সংবাদ সম্মেলন করতে না দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকার হেফাজত নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল প্রয়োগ শুরু করে। পুলিশ মাদরাসায় প্রবেশের সময় সেখানে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। পরে পুলিশের মারমুখো আচরণ দেখে অনেকে সটকে পড়েন। পুলিশ আল্লামা শফীর রুমে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে তাকে চট্টগ্রাম যেতে চাপ সৃষ্টি করে। অন্য দিকে আল্লামা বাবুনগরী তার সাথে চট্টগ্রাম যেতে চাইলে তাকে যেতে না দিয়ে তার ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। সন্ধ্যায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হেফাজতের ব্যাপারে আর কোনো নমনীয়তা প্রদর্শন করা হবে নাÑ এমন বক্তব্য আসে সরকারি তরফে।
জানা গেছে, হেফাজতের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রোববারের যে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে তা প্রত্যাহারের জন্য আল্লামা শফীসহ হেফাজত নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ হাটহাজারী মাদরাসায় গিয়ে আল্লামা শফীর সাথে একান্তে দীর্ঘ সময় কথা বলেন। মূলত কঠোর কোনো কর্মসূচি যাতে না দেয়া হয় সে জন্য আল্লামা শফীকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আল্লামা শফীকে গ্রেফতার না করা, তাকে মামলায় না জড়ানোর বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, সরকার তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে।
এ দিকে রাজধানীতে ৫ মের ঘটনার জন্য দায়ের করা মামলাগুলোতে হেফাজতের ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর প্রায় সব নেতাকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। অন্যদের আসামি করা হলেও আল্লামা বাবুনগরী ছাড়া অন্যদের গ্রেফতার করা হয়নি। সূত্র মতে, সরকারের তরফে হেফাজতের নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখেন এমন নেতাদের সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে হুলিয়াকে সামনে রাখা হচ্ছে। গ্রেফতার এড়াতে হেফাজতের নেতারা এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। মোবাইল নাম্বারেও নেতাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
একটি সূত্র জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলামের ওপর ৫ মে দিবাগত রাতে যে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয় তাতে হেফাজত নেতারা হতবাক। তাদের ধারণা ছিল সরকার আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে চলে যেতে সুযোগ করে দেবে। শাপলা চত্বর এলাকায় সমাবেশস্থলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকাকে তারা একটি ইতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়েই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু রাতে অভিযানের ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা তাদেরকে বিস্মিত করে। সাধারণ নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষের রক্ত ঝরার বিষয়টি কোনোভাবেই তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। ফলে প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন হেফাজত নেতারা। পাশাপাশি কত সংখ্যক লোক মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দোয়া পালন এবং হরতাল কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, এক দিকে আমাদের ওপর রাতের আঁধারে হামলা চালিয়ে নিরীহ আলেমদের হত্যা করা হয়েছে, অন্য দিকে মামলা দিয়ে, গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে নানাভাবে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এতে আন্দোলন স্তব্ধ হবে না। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ঈমানি দাবি আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে।