পলাশীর শিক্ষা হোক শিরোধার্য

এ এম জিয়া হাবীব আহসান
২৩ জুন, ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর কথিত যুদ্ধকে ষড়যন্ত্র বলাই শ্রেয়। কেননা ১৩ কুচক্রী যেমন- মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, ঘসেটি বেগম, ইয়ারলতিফ প্রমুখের কূটচক্রের ফল এই গ্রেট ট্র্যাজেডি। রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রের সহায়তায় আধিপত্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা দেশপ্রেমিক শক্তির রক্তে রঞ্জিত পলাশীর ময়দান থেকেই মানদণ্ড ফেলে রাজদণ্ডে হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস পোষণ করে।
সে দিন নবাবের বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটেছিল। অস্ত্র সম্ভারও ছিল; কিন্তু নবাবের পরাজয় হয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে। সপ্তাহখানেক পর কুচক্রীরা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে নির্মমভাবে হত্যা করে। মীরজাফর কিছু দিনের জন্য পুতুল নবাব হলেও তার ছায়ায় অধিষ্ঠিত হলো ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। এভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রতিনিধি রবার্ট কাইভ হলো প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে শুধু বাংলার নয়, পরবর্তী সময়ে পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের থাবা বিস্তৃত হয়। দেশ ও জাতির শত্রু কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা একটি জাতির জীবনে কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটাতে পারে পলাশী তারই বিয়োগান্ত উদাহরণ। ইতিহাসের কয়েক পাতা পেছনে উল্টালেই দেখা যাবে উপমহাদেশে ইংরেজদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজটি প্রকৃতপক্ষে সুবে-বাংলা থেকে শুরু হয়েছিল বিচিত্রভাবে। দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহান যখন মোগল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, তখন তার প্রিয় কন্যা জাহানারা মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। দিল্লির হাকিম ও কবিরাজেরা তার চিকিৎসায় ব্যর্থ। এক পারিষদ মুমূর্ষু জাহানারাকে একজন ইংরেজ ডাক্তার এনে দেখানোর পরামর্শ দিলেন। সুরাটে ইংরেজদের কাছে সম্রাট দূত পাঠালে ইংরেজরা সে সুযোগ হাতছাড়া না করে বিলাত থেকে সদ্য আগত এক জাহাজের প্রধান চিকিৎসক ডা: গাব্রিয়েল বাউটনকে দিল্লি পাঠায়। তার চিকিৎসায় সম্রাটদুহিতা সুস্থ হয়ে উঠলেন। কৃতজ্ঞ সম্রাট বাউটনকে বললেন, তিনি যে পুরস্কার চান তাই পাবেন। দেশপ্রেমিক ইংরেজ ডাক্তার নিজের জন্য কিছু না চেয়ে বললেন, সম্রাট খুশি হয়ে যদি কিছু দিতে চান তবে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুবে-বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দান করুন। সম্রাট ইংরেজ ডাক্তারের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। এই সিদ্ধান্ত ভারতবর্ষের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল সুবে-বাংলা এবং কালক্রমে সমগ্র দেশের জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি। এভাবে ইংরেজেরা বাংলায় এসেছে, বাণিজ্যের নামে এসে কুঠি গেড়েছে, বন্দর নির্মাণ করেছে। ‘পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কিংবা পণ্যের বিনিময়ে উপযুক্ত মূল্য’ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অর্থে, সৎ বাণিজ্য করতে এ দেশে আসেনি, এসেছিল নির্জলা লুণ্ঠনের জন্য। সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষার নামে ওরা গড়ে তুলেছে নিজস্ব সামরিক শক্তি। এদেশীয় সরকারের প্রতি ছিল না তাদের কোনো আনুগত্য। তারা মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে স্থানীয় রাজশক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোনো স্বাধীন দেশের সরকার এ অবস্থা মেনে নিতে পারে না। সুবে-বাংলার নবাবও তা মেনে নিতে পারেননি। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সেনাবাহিনী গঠন করে নবাবের কর্তৃত্ব অস্বীকার করলে নবাবের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রহসনের দিনে হয়েছিল একটি পাতানো যুদ্ধ। কোম্পানির তিন হাজার ২০০ সৈন্যের ুদ্র বাহিনীর হাতে নবাবের ৬৫ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী না হয় পরাজয়বরণ করতে পারে না। ৬৫ হাজার নবাব বাহিনীর ৪৫ হাজারই ছিল বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কদের অধীনে নিষ্ক্রিয়। মীরজাফর চক্রের ষড়যন্ত্রে সে দিন আমাদের জাতির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। রবার্ট কাইভ এ প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সে দিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলে লাঠিসোঁটা আর ইট মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত’। এটি হলে উপমহাদেশের ইতিহাস প্রবাহিত হতো ভিন্ন স্রোতে; কিন্তু বেখবর জাতি দেশের চরম সঙ্কটকালে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এটি পলাশীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। পলাশী ট্র্যাজেডির মূল নায়ক যারা তারা প্রায় সবাই ছিল ইংরেজ সৃষ্ট নব্য শেঠ ও বেনিয়া গোষ্ঠীভুক্ত কিংবা রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপদাধিকারী। সরকারের উচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদের রাষ্ট্রদ্রোহী শক্তির অদূরদর্শী নিয়োগ একটি বিরাট ইমারতে উইপোকার অস্তিত্বের মতো কাজ করে। পলাশী বিপর্যয় তার প্রামাণ্য দলিল। সেনাবাহিনীর গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানের মতো পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কোম্পানির স্পর্শকাতর দালাল রামবর্ম সিংকে। আধিপত্যবাদী শক্তির উচ্ছিষ্টভোগী দালাল গোষ্ঠীর তৎপরতায় সাড়ে পাঁচ শ’ বছরের গৌরবময় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে; কিন্তু মুসলমানেরা এক দিনের জন্যও ব্রিটিশদের মেনে নেয়নি। ১৯০ বছরের দীর্ঘ রক্তঝরা সংগ্রামের ফলে উপমহাদেশের নির্যাতিত মুসলমানেরা ১৯৪৭ সালে নিজেদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৭৫৭ সালে আমাদের যে ইতিহাস শুরু, এর ধারাবাহিকতায় ২৫৫ বছর ধরে আমরা স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও আগ্রাসনমুক্তির জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছি। আমাদের দেশ, জাতি, জাতীয় সম্পদ এখনো বিদেশী আধিপত্যবাদের লোলুপ থাবার শিকার। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইংরেজদের পথ অনুসরণ করে এ দেশে তাদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আরেকটি পলাশী ট্র্যাজেডির জন্য চক্রান্ত চলছে। দেশে পলাশী যুদ্ধের পূর্বাবস্থা বিরাজ করছে। আধিপত্যবাদী শক্তিকে পলাশী স্টাইলে ভেতর থেকে দুর্গ দখলে সাহায্য করছে একশ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। তারা জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত। তবে ইতিহাস সাক্ষী, মীরজাফরদের পরিণতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। জাতির বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরা কেউ-ই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেনি, করবে নাÑ এটিই অদৃষ্টের লিখন। মীরজাফরকে কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিতে হয়। তার ছেলে মীরণ, যে নবাবীর লোভে সিরাজউদ্দৌলার বংশের একটি ছেলেকেও জ্যান্ত রাখেনি, সে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারায়। দুর্লভরাম, মীরজাফর আর মীরণের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে পালিয়ে বেড়ায়। নন্দ কুমারকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়। বারবার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাব মীর কাশেম কর্তৃক মুঙ্গের দুর্গের ওপর থেকে গঙ্গা নদীতে জীবন্ত নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বিশ্বাসঘাতক শিরোমণি জগৎশেঠ ও রাজা রায়দুর্লভ। ওয়াটস কোম্পানির কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে বিলেতে পালিয়ে মনের দুঃখে সেখানে মারা গেলেন। স্ক্রাফটন জাহাজডুবি হয়ে মরলেন। স্বয়ং রবার্ট কাইভ ‘ব্যারন অব প্ল্যাসি’ হয়েও নিজের হাতে গলায় ুর চালিয়ে আত্মহত্যা করলেন। এই মাটি ও মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের ইতিহাসে পরিণতি এভাবেই হয়েছে। যারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে বিদেশী বলেছেন, যারা তার চরিত্রে কালিমা লেপন করছেন, তাদের সামনে জাতীয় বেঈমানদের পরিণতির কিয়দংশ তুলে ধরলাম। লাখো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে নিয়ে পলাশীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, আমাদের মধ্যেই মীরজাফর, জগৎশেঠ ও ঘসেটি বেগমদের তৎপরতা ও কর্তৃত্ব। সার্বভৌমত্ব হরণ তাদের দিয়েই করানো হচ্ছে। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নস্যাতে তারাই সবচেয়ে তৎপর। বিদেশী আগ্রাসী চেনা যায়। এদের চেনা বড় মুশকিল। সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে ফেলতে হবে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর রক্তঋণের উত্তরাধিকারীরা আর কোনো পলাশী মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। পলাশীর শিক্ষাকে সামনে রেখে এ মুহূর্তে জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টি করে বিপন্ন স্বাধীনতাকে রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে বিশ্বাসঘাতকদের সব ষড়যন্ত্র নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ভেতর থেকে দুর্গ দখলের কৌশল সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে সমগ্র জাতিকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামি মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদই এ দেশের ১৪ কোটি মানুষের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একমাত্র গ্যারান্টি। পলাশীর শিক্ষা হোক আমাদের জন্য, দেশপ্রেমিক শক্তির জন্য শিরোধার্য। নচেৎ শত বছরের জন্য আবারো আমরা হয়তো আবদ্ধ হয়ে পড়ব গোলামির জিঞ্জিরে। 
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।