মিয়ানমারে মুসলিম নিধন

এবনে গোলাম সামাদ
আমাদের লাগোয়া দেশ মিয়ানমার। দেশটিকে এক সময় আমরা বাংলায় বলতাম ব্রহ্মদেশ। আর ইংরেজিতে বলতাম বার্মা (Burma)। ফারসিতে বলা হতো বারহামা। এই বারহামা নাম থেকেই ইংরেজিতে উদ্ভব হতে পেরেছিল বার্মা নামটি। ‘ম্রনমা’ শব্দটার মানে হলো মানুষ, যাদের আমরা এক সময় বলতাম বর্মি, তারা নিজেদের বলেন ‘ম্রনমা’। মিয়ানমার নামটি এসেছে ম্রনমা নাম থেকে। ১৯৮৯ সালে ১৮ জুন থেকে বার্মার সরকারি নাম রাখা হয়েছে মিয়ানমার। ম্রনমা ভাষায় ‘র’-এর উচ্চারণ করা হয় না। যদিও তা লেখা হয়। তাই ম্রনমা ভাষায় দেশটির নাম দাঁড়ায় উচ্চারণগতভাবে মিয়ানমা।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্মি ভাষা যে অক্ষরে লেখা হয়, তার উদ্ভব হয়েছে ব্রহ্মীলিপি থেকে। বাংলা অক্ষর আর বর্মি দেখতে অনেক আলাদা হলেও উচ্চারণগতভাবে তাই খুঁজে পাওয়া যায় মিল। ম্রনমা ভাষা চীনা ভাষা পরিবারভুক্ত। কিন্তু লেখা হয় না চীনা ভাষার মতো চিত্রাক্ষরে। লেখা হয় আমাদের মতো ধ্বনি ও শব্দাংশের (Syllabic) ধারায়। ম্রনমা ভাষাকে বৃহৎ চীনা পরিবারভুক্ত ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ বৃহৎ চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় বিভক্তি প্রত্যয় ও উপসর্গ থাকে না। একই শব্দ কিছুটা উচ্চারণের ধরন অনুসারে বাক্যের অর্থ প্রকাশ করে। ম্রনমা ভাষা আর বাংলা ভাষা কাছের ভাষা নয়। যদিও মিয়ানমার হলো আমাদের লাগোয়া দেশ। বার্মার সবচেয়ে বড় নদী ইরাবতী। ইরাবতী নামটি পালি ভাষার। ম্রনমা ভাষার নয়। ইরাবতী নামে নদী ভারতের পাঞ্জাবেও আছে। বৌদ্ধধর্ম দু’টি বড় ভাগে বিভক্ত : মহাযান ও হীনযান। চীন হলো মহাযান বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে প্রভাবিত। কিন্তু মিয়ানমার হলো থেরাবাদী বা হীনযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। যেমন হলো শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কিছু অংশের মানুষ। তবে মিয়ানমারে হিন্দুধর্মের দেবদেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। আর পাওয়া গেছে মহাযান বৌদ্ধধর্মেরও পূজিত বধিসত্ত্বের মূর্তি। তবে এখন ম্রনমারা হলেন হীনযান বা থেরাবাদী বৌদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এরা অনেক রকম আত্মার পূজা করেন। যাদের বলা হয় নাথ। ধর্মের কথা বলতে হচ্ছে, কারণ ধর্ম নিয়ে মিয়ানমারে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। মিয়ানমারে চলেছে মুসলিম নিধন। ধর্মের দিক থেকে একটি পুরনো হিসাব অনুসারে মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ হলেন থেরাবাদী বৌদ্ধ। পাঁচ শতাংশ হলেন প্রেতাত্মার পূজারি (Animists), চার শতাংশ হলেন মুসলমান, চার শতাংশ হিন্দু আর তিন শতাংশ হলেন খ্রিষ্টান। মিয়ানমারে যে কেবল ধর্ম নিয়ে বিরোধ আছে, তা নয়; ভাষাগত জাতিসত্তা নিয়েও আছে বিশেষ বিরোধ। আছে কারেন, কাচিন, শানদের সাথে ম্রনমাদের বিরোধ। এ বিরোধ ভাষাগত ও এদের ঐতিহাসিক উদ্ভবগত। কারেনেরা অবশ্য এখন বেশির ভাগই গ্রহণ করেছেন খ্রিষ্টান ধর্ম। তাই কারেনদের সাথে ম্রনমাদের বিরোধ ঘটছে কেবল ভাষাগত কারণেই নয়, ধর্মগত কারণেও। কারেন, কাচিন ও শান হতে চাচ্ছে স্বাধীন। তাদের তাই যুদ্ধ চলেছে ম্রনমাদের সাথে। মিয়ানমারে মুসলমানদের সাথে ম্রনমা থেরাবাদী বৌদ্ধদের দাঙ্গা ব্রিটিশ শাসনামলেও হয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে হচ্ছে, তখন ঠিক সেভাবে হতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা ছিল তখনকার ভারতের সবচেয়ে বড় প্রদশে। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশশাসিত ভারত থেকে বার্মাকে পৃথক করে পরিণত করা হয় ব্রিটিশশাসিত একটি পৃথক রাজ্যে। এ সময় থেকে রচিত হয় বর্তমান মিয়ানমারের মানচিত্র। বর্তমান মিয়ানমারের মানচিত্র সৃষ্টি হতে পেরেছে ব্রিটিশ শাসনেরই ফলে। এর আগে মিয়ানমার ছিল একাধিক রাজ্যে বিভক্ত। মিয়ানমারে কখনো ইসলাম প্রচার হয়নি, যেমন হতে পেরেছে ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের সাথে লাগোয়া দেশ মালয়েশিয়ায়। মিয়ানমারের মুসলমানেরা হলো ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত থেকে যাওয়া। আরাকান এখন মিয়ানমারের অংশ। কিন্তু আরাকান (যাকে এখন বলা হচ্ছে রাখাইন প্রদেশ) তা ছিল গৌড়ের সুলতানদের সামন্তরাজ্য। আরাকানের এক রাজা (মেং সোআম্উন) পালিয়ে আসেন গৌড়ে। কারণ দক্ষিণ বার্মার এক রাজা দখল করেন তার রাজত্ব। গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ্দীন মুহম্মদ শাহ তাকে তার রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সৈন্যসামন্ত দিয়ে সাহায্য করেন। এবং তিনি তার রাজত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারেন গৌড়ের প্রদত্ত সৈন্যসামন্ত দিয়ে, যাদের বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমান, তারা প্রধানত হলেন এদের বংশধর। আরাকানের রাজা গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যসামন্তকে তার রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রেখে দেন আরাকানে। আরাকানের রাজা নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, যার নাম দেন রোহং। রোহংকে বাংলায় বলা হতে থাকে রোসঙ্গ নগর। এক সময় গোটা আরাকানকেই বাংলায় বলা হতো রোসাঙ্গ দেশ। আরাকানের সব মুসলমানই অবশ্য রোহিঙ্গা নন। যদিও আরাকানবাসী মুসলমানেরা সাধারণভাবে এখনো রোহিঙ্গা নামেই পরিচিত। কিন্তু পুরো উত্তর আরাকানে এক সময় চলেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। আরাকানের উত্তরাঞ্চলে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু মুসলমান গিয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকানসহ পুরো বার্মা চলে যায় জাপানের দখলে। আরাকানে মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ব্রিটেন বলে, আরাকান আবার তারা ফিরে পেলে উত্তর আরাকানকে পৃথক করে গড়া হবে একটি পৃথক প্রদেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হারে। কিন্তু উত্তর আরাকানে ব্রিটেন একটি পৃথক প্রদেশ গড়ার সুযোগ পায় না। ১৯৪৮ সালে বার্মাকে দিতে হয় স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সাল থেকে বার্মায় চলেছে জাতিসত্তার সঙ্ঘাত। আরাকানে সৃষ্টি হয় মুসলমান ও আরাকানি বৌদ্ধদের মধ্যে সঙ্ঘাত। আরাকানি মুসলমানেরা পাকিস্তানের কাছ থেকে সাহায্য চায়, কিন্তু পাকিস্তান চায় না বার্মার সাথে সঙ্ঘাতে জড়াতে। কারণ বার্মার সাথে যুদ্ধ করার মতো সামরিক শক্তি তার ছিল না। আর এমন কোনো যুদ্ধ শুরু হলে ভারত গ্রহণ করত বার্মার পক্ষ। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিরাপত্তা হয়ে পড়ত অনিশ্চিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার সময় চাকমারা ওড়ান ভারতের পতাকা। অন্য দিকে ১৯৪৮ বার্মা স্বাধীন হতে না হতেই বন্দরবানে ম্রনমা বংশোদ্ভূত মারমারা ওড়ান বার্মার পতাকা। এ অঞ্চলের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে হলে অতীতের এসব ঘটনার কথা ভুলে গেলে চলে না। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ-ভারত থেকে বহু মানুষ বার্মায় গিয়েছিলেন চাকরি ও ব্যবসা করার জন্য। ইংরেজদের পরই বার্মার সব বড় বড় সরকারি চাকরি, সমুদ্রপথে যাওয়া সেই সময়ের অন্য প্রদেশের ভারতীয়রা দখল করে নেয়। এমনকি কেরানির চাকরিতেও তারাই লাভ করে প্রাধান্য। ইংরেজদের পরই ব্যবসায়-বাণিজ্য চলে যায় সমুদ্রপথে যাওয়া ভারতীয়দের হাতে। অনেক ভারতীয় বার্মায় গিয়ে সুদে টাকা খাটিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে হয়ে ওঠেন খুব ধনী। অনেকে বার্মায় কিনে ফেলে প্রচুর ভূসম্পত্তি। বর্মিরা নিজভূমে হয়ে পড়তে চান পরবাসী। বর্মি জাতীয়তাবাদ তাই যেমন হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী, তেমনি আবার হয়ে ওঠে ব্রিটিশের সহযোগী ভারতীয়দের বিরোধী। ব্রিটিশ শাসনামলে সেই সময়ের ভারত থেকে প্রায় ১০ লাখ লোক সমুদ্রপথে যায় বার্মাতে। যাদের একটি বড় অংশ স্থলপথে অনেক কষ্ট করে বার্মা থেকে পালিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে (চট্টগ্রাম অঞ্চলে)। পালিয়ে আসার সময় অনাহারে ও ডাকাতদের হাতে মারা যান অনেকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বার্মা থেকে আসা ভারতীয় শরণার্থী মানুষকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয় ভারতে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে। কিন্তু কিছু ভারতীয় থেকে যান বার্মার মূল ভূখণ্ডে, যাদের মধ্যে ছিলেন বেশ কিছু মুসলমান। আর এদের সাথেই এখন সঙ্ঘাত বেধে উঠেছে বৌদ্ধ ম্রনমাদের। কিন্তু এই সঙ্ঘাত হচ্ছে খুবই একতরফাভাবে। অন্য দিকে আরাকানে চলেছে রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন। মিয়ানমার সরকার আইন প্রণয়ন করেছেন, আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা প্রতি পরিবারে দু’টির বেশি সন্তান নিতে পারবেন না। কারণ তা হলে আরাকান হয়ে উঠবে রোহিঙ্গা মুসলমান প্রধান অঞ্চল। আমরা বাংলাদেশে মারমাদের সম্পর্কে এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন দেখিনি। মারমাদের সাথে করছি যথেষ্ট হার্দিক ব্যবহার। তথাপি বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে নাকি মুসলিম মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে না হতেই বাংলাদেশেই গঠন করা হলো হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ, যার পক্ষ থেকে তোলা হলো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের স্বার্থসংরক্ষণের উদ্ভট দাবি। চাকমা, মারমা, মগÑ এরা সবাই এসেছেন বাংলাদেশে বাইরে থেকে। সেটি খুব বেশি দিন আগের কথা নয় (অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে)। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু পণ্ডিত এদের চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন আদিবাসী (Aborigine) হিসেবে। এদের মধ্যে আছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও। এদের পাণ্ডিত্য আমাদের বিস্মিত না করেই পারে না।

মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ হামলার কথা নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী লেখা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক Time পত্রিকায় (১ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায়)। টাইম পত্রিকা মুসলিমদের দিয়ে কোনোভাবেই প্রভাবিত নয়। তার প্রতিবেদনকে তাই গ্রহণ করতে হয় যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে। মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে চলেছে সামরিক শাসন। সেখানে নেই কোনো গণতন্ত্র। মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা বৌদ্ধ পুরোহিতদের সমর্থনে চালাতে চেয়েছেন দেশকে। উগ্র বৌদ্ধবাদীদের এরা দিয়েছেন আশকারা। যার ফলে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পেরেছে। এতে মিয়ানমারের হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন না। কারণ তাহলে তাদের পড়তে হবে ভারতের আক্রোশে। কিন্তু মুসলমানদের হত্যাসহ বৌদ্ধ ধর্মের জয়গান করে বার্মার সামরিক জান্তা যেন পেতে চাচ্ছে সে দেশের বিরাট জনসমর্থন। মুসলমানেরা সে দেশে হয়ে উঠেছেন বিশেষ ঘৃণাবস্তু। রাজনৈতিক পরিভাষায় ইংরেজিতে যাকে বলে Hate-object এমন ঘৃণাবস্তু সৃষ্টি করে রাজনীতি করার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোটেও বিরল নয়। বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা হলো, অহিংসা পরম ধর্ম। কিন্তু ধর্মের নামে বৌদ্ধরা হয়ে উঠছেন যথেষ্ট হিংস্র। বৌদ্ধ ধর্মের মর্মবাণী বৌদ্ধদের হাতে হতে পারছে অস্বীকৃত।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট