জিহ্বা কর্তনের রাজনীতি-সোহেল মাহমুদ
১৪ দলীয় জোট সরকারের সমর্থক ও সেকুলার ঘরানার একগুচ্ছ নারীর উপস্থিতিতে বিগত ১১ মে (২০১৩) হয়ে গেল ‘প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশ’। প্রচারণা ও প্রস্তুতি দেখে মনে হয়েছিল বোধ হয় লাখ লাখ নারীর সমাবেশ ঘটবে; কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দারুণ হতাশ করেছে সমাবেশের উপস্থিতি। কারো মতে, শ’দুয়েক, কারো মতে শ’পাঁচেক আর কেউ বলেছেন সর্বোচ্চ এক হাজার নারী ওই সমাবেশে দর্শকশ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিল। উপস্থিত সাধারণ নারীদের দেখে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে যে, তারা কোথা থেকে এসেছে। একটি পত্রিকা লিখেছে, তাদের কেউ কেউ ট্রাক থেকে নামতেই চায়নি।
কারণ তারা ঢাকা শহর ভালোভাবে চিনে না বলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ছিল। আর বক্তা ও নারীনেত্রীদের কথা তো বলারই অপো রাখে না। তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয় বলতে গেলে সবাই কম-বেশি জানেন। সমাবেশের সাউন্ড সিস্টেম ছিল তোপখানা মোড় থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত। সংগঠক ও উদ্যোক্তাদের ল্য ছিল কয়েক লাখ নারীকে হাজির করা। দেখানো যে, হেফাজতে ইসলাম লাখ লাখ লোক আনতে পারলে আমরা প্রগতিশীলরাও পারব না কেন? নারীদের এ সমাবেশটি আগেই হওয়ার কথা ছিল। পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে যে সরকার গার্মেন্ট মালিকদের চাপ দিচ্ছিল তাদের নারীশ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ওই সমাবেশে পাঠাতে। এমনকি বিজিএমইএর ভবন রার জন্য সমাবেশে শ্রমিক পাঠানোর শর্তও দেয়া হয়েছিল। অবশেষে সাভার রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তাদের সেসব পরিকল্পনাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। সাভার ট্র্যাজেডির চোখের পানি শুকানোর আগেই এই ‘প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশ’ আয়োজন কেন এত জরুরি হয়ে পড়েছিল, তা আয়োজকেরাই ভালো বলতে পারবেন। তদুপরি সেটি পুরোপুরি ফপ হওয়ায় আয়োজক ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরাও খুবই হতাশ হয়েছেন। এমনকি তাদের সমর্থক ইলেকট্রনিক চ্যানেলগুলোও নারী সমাবেশের খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে লজ্জা পাচ্ছিল। এর পরও বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখা এ জন্য প্রয়োজন যে, ওই সমাবেশের উদ্যোক্তা নারী নেত্রীরা প্রায়ই দেশের নারীসমাজের পে নানা কথা বলে থাকেন এবং সেসব কথায় বেশ তেজ থাকে; অবশ্য সব সময় তাতে সারবত্তা থাকে না। তারা নিজেদের সবজান্তা ভাব দেখান এবং রাজপথে আর সেমিনার-কর্মশালায় নারীদের নেতৃত্ব দেন। আবার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তারা বাংলাদেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, যদিও দেশের বৃহত্তর নারীসমাজের মূল্যবোধের সাথে রয়েছে তাদের যোজন যোজন দূরত্ব। এর বড় প্রমাণ হলো তাদের ডাকে সেই দিন সাড়া দেয়নি নারীসমাজ। কিভাবে সেটিই বলছি।
ওই সমাবেশে নারীনেত্রীরা বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা সরাসরি নারীর অধিকার ও সম্মানের প্রতি আঘাত। হীন উদ্দেশ্যে এসব দেয়া হয়েছে। দেশের নারীরা এর একটিও মানবে না। (দৈনিক প্রথম আলো : ১২ মে ২০১৩) তারা ওই সভায় বিস্তারিত কী বলেছেন, আমরা জানি না। শুধু পত্রিকায় যতটুকু ছাপা হয়েছে তার ভিত্তিতে দেখা যায়, তারা হেফাজতের কোন্ দফাটি তাদের ‘অধিকার ও সম্মানের প্রতি আঘাত’ তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার প্রতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট, সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকেই নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন। বলার অপো রাখে না যে, এসব দল মিলিতভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তা হলে এসব নারীনেত্রী কিসের ভিত্তিতে দাবি করেন যে, ‘দেশের নারীরা হেফাজতের দাবির একটিও মানবে না’? দেশের নারীদের পে কথা বলার কোনো অধিকার কি তাদের আছে? তাদের ডাকে তো সমাবেশে হাজারখানেক নারীও উপস্থিত হয়নি।
এবার দেখা যাক, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার প্রতি তাদের এত ােভ কেন? তাদের প্রথম দফায় বলা হয়েছে : সংবিধান থেকে বাতিলকৃত অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করতে হবে। এ নীতিবাক্যটি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশিত ছিল এবং দেশবাসী এ নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। এর ফলে দেশে কখনো কোনো সঙ্কটও সৃষ্টি হয়নি। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১ সালে যখন মতায় তখনো তা সংবিধানে ছিল। এ জন্য তারা সরকার চালাতে কোনো সমস্যায় পড়েছে বলেও শোনা যায়নি। যে দেশের ৯০ ভাগ লোক মুসলমান সে দেশের কোনো নিষ্ঠাবান মুসলিম সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি তুলে দেয়ার কথা বলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী হলে এ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করতে পারে। হেফাজতে ইসলামের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত যে সাড়া দেখা গেছে, তা দিয়ে জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন বুঝতে কঠিন হওয়ার কথা নয়। বস্তুত বিষয়টি ঈমানের দৃঢ়তার সাথে সংশ্লিষ্ট। তথাকথিত প্রগতিশীল নারীনেত্রীরা কি তা হলে ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও আস্থাশীল নন? সাহস থাকলে কথাটি তারা পরিষ্কার করে বলতে পারেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখিরাতের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।’(সূরা বাকারা : আয়াত ৮-৯)
হেফাজতে ইসলামের দ্বিতীয় দফায় আল্লাহ, নবী-রাসূল, ইসলাম ও আল কুরআনের অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তথাকথিত প্রগতিশীল নারীনেত্রীরা কি তা হলে ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের প অবলম্বন করছেন? তাদের বল্গাহীনভাবে ইসলামের প্রতি আপত্তিকর লেখা ও বলার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন? তাই যদি হয় তা হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি সীমাহীন? আপনি চাইলেই কি আজেবাজে বা অশ্লীল কথা অথবা কাউকে খুন করার কথা সমাজে বলতে পারেন? একটি সুস্থ সমাজ তো সেটাই যেখানে সবাই পরস্পরের প্রতি মর্যাদাশীল থাকে। সুতরাং যারা ধর্মকে আক্রমণ করে বিকৃত পুলক অনুভব করে তারা সমাজে হানাহানি আনতে চান। কোনো সমাজই তাকে প্রশ্রয় দেয় না। আর সে জন্যই আমাদের দেশেও আইন রয়েছে তবে তা কঠোর নয়। নারীনেত্রীরা বলুন আপনারা কি ধর্মের বিশেষত ইসলামের অবমাননাকে প্রশ্রয় দেবেন? নাকি দেবেন না? যদি না দিতে চান তা হলে আইন প্রণয়নে আপনাদের আপত্তি কেন? ‘জাতির পিতাকে’ কটা করলে যদি শাস্তি হতে পারে তা হলে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বললে বা লিখলে কেন শাস্তি দেয়া যাবে না?
হেফাজতে ইসলামের তৃতীয় দফায় তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্লগার, নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপতৎপরতা ও প্রচারণা বন্ধ করার দাবি করা হয়েছে। এসব নাস্তিকের বিষয়ে আগেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ছিল এবং বিলম্বে হলেও সরকার কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি আরো অনেক নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা সরকারের কাছে দাখিল করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকেরা বিষয়টি উপলব্ধি করে তাদের মঞ্চে আজানের বিরতি, কুরআন তিলাওয়াত চালু করে ইসলামের প্রতি সম্মান দেখানোর চেষ্টাও করেছেন। তারা বলেছেন, গণজাগরণ মঞ্চের সবাই নাস্তিক নয়। ভালো কথা, তা হলে যারা ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক তাদের সেখানে প্রশ্রয় না দিলেই চলত। সুতরাং নারীনেত্রীরা হেফাজতে ইসলামের তৃতীয় দফার সাথে একমত না হওয়া মানে কি তারা ধর্মবিদ্বেষি নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন নেয়া সমর্থন করেন না? তা হলে সেটা পরিষ্কার করে তারা বলতে পারেন জনগণ চিনে নিতে পারবে।
হেফাজতে ইসলামের চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় নারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে : ‘নারীদের নিরাপদ পরিবেশে শিা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থল, সম্মানজনক জীবিকা এবং কর্মজীবী নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক’। এ দাবিটি নারীনীতির ১৬.২ ও ২৩.৭ ধারার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ ১৬.২ ধারায় বলা হয়েছে : ‘রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সব েেত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ অন্য দিকে ২৩.৭ ধারায় বলা হয়েছে : ‘নারী-পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি, শ্রমবাজারে নারীর বর্ধিত হারে অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরিেেত্র বৈষম্য দূর করার।’ এ ধারাও হেফাজতের দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বরং হেফাজতের দাবিটি নারীনীতির চেয়েও বেশি নারীবান্ধব। কারণ নারীনীতি নারীকে পুরুষের সমান মজুরির কথা বলেছে; পান্তরে হেফাজতে ইসলাম ন্যায্য পারিশ্রমিকের কথা বলেছে। সবাই জানে, নারীরা বিশেষ করে গার্মেন্টকর্মীরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না।
হেফাজতে ইসলামের দাবির মধ্যে আরো আছে, ‘নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারীদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহিংসতা, যৌতুক প্রথাসহ যাবতীয় নারী-নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমন করা হোক’। এ ছাড়াও ‘নারীরা ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে ইজ্জত-আবরু, যৌন হয়রানি থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক’। পান্তরে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ১৮.৬ ধারায় বলা হয়েছে : ‘শিাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রাস্তাঘাটে নারী শিশু যেন কোনো রকম যৌন হয়রানি, পর্নোগ্রাফি ও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা’। অন্য দিকে ১৯.১ ধারায় বলা হয়েছে : ‘পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এবং কর্মেেত্র নারীর প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, অ্যাসিড নিপেসহ নারীর প্রতি সব সহিংসতা দূর করা।’ হেফাজতে ইসলামের এ দাবিও নারী উন্নয়ন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এরপর বাকি থাকে হেফাজতে ইসলামের দাবির আরো দু’টি অংশ : ১. নারীদের পোশাক ও বেশ-ভূষায় শালীনতা প্রকাশ এবং হিজাব পালনে উদ্বুদ্ধকরণ এবং ২. নারী-পুরুষের সব ধরনের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা বন্ধ করা। এই দুটো বিষয় সম্পর্কে নারীনীতিতে কিছু বলা হয়নি। অথচ নারীর শালীনতা ও পোশাক সম্পর্কে দিকনির্দেশনা নারীনীতিতে থাকা উচিত ছিল। একজন মুসলিম নারীর জন্য এটি একটি মৌলিক বিষয়। প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা সম্পর্কে আমাদের পেনাল কোডেই শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং সেটি বাস্তবায়ন শুধু সরকারের আন্তরিকতার সাথে প্রয়োগের বিষয়।
মনে হচ্ছে শেষোক্ত দু’টি বিষয়েই সেকুলার ও তথাকথিত প্রগতিশীল নারী গোষ্ঠীর যত আপত্তি। বিশেষ করে হিজাব পালনের দাবিটি তাদের কাছে অসহনীয় এবং কারো কারো কাছে তা ‘আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে’ বা ‘মধ্য যুগে ফিরে যাওয়া’ বা ‘মানবতাবিরোধী’ বা ‘নারীর শক্তিকে দুর্বল করার’ নামান্তর। এ ছাড়া নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করার দাবিকে তারা ‘প্রগতিবিরোধী’ মনে করছেন। হয়তো এসব ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা ১৩ দফার বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে প্রচারণা শুরু করেছেন। তারা বলছেন : হেফাজতে ইসলাম নারীদের চাকরি করতে দিতে চায় না এবং ঘরের বাইরে যেতে দিতে চায় না।
সচেতন পাঠকেরা ল করুন যে, হেফাজতে ইসলামের দাবির মধ্যে নারীদের চাকরি বন্ধ করার কোনো দাবি নেই। বরং তারা ‘কর্মজীবী নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা’ করার দাবি করেছেন। তারা ‘কর্মস্থলে নারীদের ইজ্জত-আবরু, যৌন হয়রানি থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক হিসেবে পোশাক ও বেশ-ভূষায় শালীনতা প্রকাশ এবং হিজাব পালনে উদ্বুদ্ধকরণসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার’ দাবি করেছেন। বাংলাদেশের নারীরা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ঐতিহ্যগতভাবে ন্যূনতম ধর্মীয় শালীনতা বজায় রেখেই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে। অনেকেই হিজাব পরেন। এটিই আমাদের আবহমানকালের সংস্কৃতি ও সামাজিক অনুশাসন। ইদানীং হিজাব পরা অনেক নারী সমাজের উঁচুস্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের দুই নারীনেত্রীও মাঝেমধ্যে হিজাব পরে থাকেন। ইসলামের দৃষ্টিতে হিজাব হচ্ছে মুসলিম নারীদের জন্য সর্বোত্তম, তা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলামের দাবির মধ্যে হিজাবকে বাধ্যতামূলক না করে ‘উদ্বুদ্ধ’ করার জন্য বলা হয়েছে। সুতরাং হেফাজতে ইসলামের কোন দাবিটি নারী স্বার্থের বিরোধী?
বিশিষ্ট নারীনেত্রী ফরিদা আক্তার যথার্থই বলেছেন : ‘নারী-পুরুষের সব ধরনের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা কঠোর হাতে দমন করতে হবে’Ñএ দাবিটি হেফাজত বা কোনো ইসলামি দলের কাছ থেকে না এসে যদি কোনো রাজনৈতিক দল, কিংবা নারী সংগঠনের প থেকে আসত, আমরা একে স্বাগতই জানাতাম হয়তো। এ অবস্থা পরিবর্তন করা প্রগতিশীল নারীদেরও দাবি হতে পারে এবং হয়েছে।’ (পরিবর্তন ১৩ এপ্রিল ২০১৩) ফরিদা আক্তার আরো বলেন : ‘অনেকে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানলে আমরা মধ্য যুগে ফিরে যাবো। কেমন করে? সেটা কিন্তু কেউ পরিষ্কার করে বলছেন না। প্রথমত, মধ্যযুগ বর্তমান যুগের চেয়ে মন্দ ছিল কি না সেটা একটা তর্কের বিষয়।’
হেফাজতে ইসলামের ষষ্ঠ দাবিটি হচ্ছে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোর নামে শিরক-সংস্কৃতিসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ভাস্কর্যকে সেকুলারেরা সৌন্দর্য চর্চার একটি মাধ্যম মনে করেন; কিন্তু সেটি ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা গ্রহণযোগ্য বা আদৌ অনুমোদনযোগ্য কি না সে সম্পর্কে সঠিক মতামত দিতে পারেন একমাত্র আলেম ও ইসলামি স্কলারেরা। দেশের বিশিষ্ট আলেমরা কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে ভাস্কর্যকে হারাম গণ্য করেন। যে জিনিসটি ইসলামের মাপকাঠিতে বর্জনীয় একটি মুসলিম দেশের সরকারের উচিত নয় তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। এরূপ ভাস্কর্য কোনো মুসলিম দেশে আছে কী নেই সেটি বিবেচ্য হতে পারে না। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন একটি বিশেষ ধর্মের আনুষ্ঠানিক আচারের পর্যায়ে পড়ে; সুতরাং সেটি মুসলমানদের জন্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও একদল মুসলমান নামধারীর কাছে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন ভীষণ পছন্দের। প্রশ্ন হচ্ছে ব্যক্তিগতপর্যায় থেকে বিষয়টি রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলে তখন সেটি হয় আপত্তির।
হেফাজতে ইসলামের সপ্তম দাবিটি হচ্ছে রেডিও-টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি নিয়ে হাসিঠাট্টা করা ও ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে অভিনয় করার মাধ্যম তরুণদের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা। এ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন দেশের সরকারপ্রধান স্বয়ং। এ বিষয়ে মূলত সরকারই কার্যকর পদপে নিতে পারে। সুতরাং এ নিয়ে নারীনেত্রীদের কিছু করার নেই। তবে ধারণা করা যেতে পারে যেহেতু নারীনেত্রীরা দাড়ি-টুপি আর ধর্মীয় লেবাস নিয়ে তামাশা চালিয়ে যাওয়া সমর্থন করেন, সেহেতু তারা হেফাজতের দাবিকে অবজ্ঞা করবেনই।
অষ্টম দাবিটি হচ্ছে বায়তুল মোকাররমসহ সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি অপসারণ ও ওয়াজ-নসিহতে বাধা দান বন্ধ করা। এ বিষয়টিও মূলত সরকারি পদপে নেয়ার বিষয়। সুতরাং এ নিয়েও নারীনেত্রীদের বেশি কিছু করার নেই। তবে আমাদের সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো ধর্মের অনুশাসন পালনে কেউ বাধা দিতে পারে না। নাগরিকের এ অধিকারটিকে সরকারই সুরা দিতে বাধ্য।
হেফাজতে ইসলামের নবম দাবিটি হচ্ছে : ঈমান ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও ও খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্মান্তকরণ তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। দশম দাবি : কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা। বিভিন্ন মুসলিম দেশে এটি করা হয়েছে। একাদশ দাবি : নবীপ্রেমিক আলেম, মাদরাসাছাত্র, ইমাম ও জনতাকে দমন-পীড়ন ও হত্যা বন্ধ করতে হবে। দ্বাদশ দাবি : গ্রেফতারকৃত আলেম, মাদরাসাছাত্র, ইমাম ও জনতাকে মুক্তি দিতে হবে।
ত্রয়োদশ দাবি : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ দাবি তো দেশের সব মানুষের। ওই সমাবেশে আদিবাসী প্রতিনিধি রেবেকা সরেন বলেছেন : ‘হেফাজতে ইসলাম নারীদের ঘরের ভেতরে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। তাদের বলতে চাই, সতর্ক হয়ে যান। দ্বিতীয়বার কোনো কথা বললে জিহ্বা কেটে রেখে দেবো।’ (দৈনিক প্রথম আলো : ১২ মে ২০১৩) হেফাজতে ইসলাম রেবেকা সরেনদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। যেখানে তার উচিত ছিল হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ জানানো, সেখানে তিনি দেশের বরেণ্য আলেমদের জিহ্বা কেটে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এগুলো কিসের আলামত?
দেখা যাচ্ছে, হেফাজতের শেষের পাঁচটি দাবিই একান্তভাবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়। এসব বিষয়ে নারীনেত্রীদের বেশি কিছু করার নেই। তবুও তারা বলছেন, এগুলো মানা যাবে না। যে বিষয়টি তাদের এখতিয়ারে নেই সে সম্পর্কে তারা কথা বলছেন কোন যুক্তিতে? নাকি সরকার তাদের শিখিয়ে দিয়েছে? নাকি একটি বিশেষ ল্েয দেশের আলেমদের একটি ‘খারাপ নাম’ দেয়ার অপচেষ্টা চলছে