ঢাকা অবরোধ থেকে শিক্ষা নিতে হবে-সিরাজুর রহমান তারিখ: 8 May, 2013
পাঁচ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা জলচ্ছায়া হয়ে থাকবেÑ যেমন আছে অনেক ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সেকুলারিজমের নামে এ দেশের সংখ্যাগুরুর ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণার প্রতিবাদে রাজধানীতে সমবেত হয়েছিল। কত লোক হয়েছিল, বলা কঠিন। সরকারের অনুগত মিডিয়া বলতে গেলে, এই সমাবেশেকে ‘সেন্সর’ করেছে। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বৈদ্যুতিক মিডিয়া এই ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ সরাসরি প্রচার করেনি। সংবাদেও সমাবেশের যথাযথ প্রতিফলন হয়নি। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, লাখ লাখ মানুষ এসেছিল এই প্রতিবাদে।
এখন সরকার দিগন্ত এবং ইসলামিক টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে সত্যকে ব্ল্যাক-আউট করার আয়োজন এখন সম্পূর্ণ। দু’বছর আগে সরকার লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্র প্রচার করেছিল। লক্ষ্য ছিলÑ বিদেশীদের এটা বোঝানো যে, বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদের স্বাধীনতার ঢল বইয়ে দেয়া হয়েছে।
পাগলাকে সাঁকো নাড়াতে নিষেধ করা একটা সুপ্রাচীন প্রবচন। কিন্তু এর বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিলাস বলে মনে হয়। তারা ঘুমন্ত সিংহের লেজে চিমটি কাটতে ভালোবাসে। পশুরাজ ঘুম ভেঙে গর্জন করে উঠলে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। পাঁচ মের সকাল থেকে পরদিন ভোর রাত ৪টা পর্যন্ত ঢাকায় যা ঘটেছে এটা তার যথাযথ উপমা বলে মনে হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ, গ্রামের কৃষিজীবী ও তাদের সন্তান, ুদ্র ব্যবসায়ী, স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকÑ বলা যায়, যারাই একটা গোল টুপি সংগ্রহ করতে পেরেছে তারাই হেফাজতে ইসলামের রাজধানী অবরোধ কর্মসূচিতে শরিক হয়েছিলের। এদের বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, দল কিংবা শ্রেণীর প্রতিভূ কিছুতেই বলা যাবে না। কেননা এরাই হচ্ছে বাংলাদেশ। একাত্তরে এরা মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলÑ শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানে, আওয়ামী লীগের নেতাদের বেশির ভাগ তখন ভারতে।
হেফাজতে ইসলাম ৬ এপ্রিলও ঢাকায় শাপলা চত্বরে একটা সমাবেশ করেছিল। সেদিনও কয়েক লাখ মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছিল। সরকার প্রথমে তাদের সমাবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, রাজধানীকে অবরুদ্ধ করেও জনতার স্রোত ঠেকানো যাবে না, তখনই সে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল। পাঁচ মেতে একই ভুল করেছে সরকার। এবারে ঢাকাকে অবরুদ্ধ করেছিল হেফাজত। সমাবেশ করার অনুমতি সরকার প্রথমে দেয়নি। যখন দেখা গেল পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তখনই সকাল ১১টায় শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল ‘টু লিটল টু লেট’।
ষাঁড়কে লাল শালু দেখাতে নেই
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশেষ সর্বত্র দেখা গেছে, আবেগ-সঞ্চালিত জনতাকে (বিশেষ করে তরুণদের) মুখোমুখি বাধা দিলে তারা সে বাধা চুরমার করার অনুপ্রেরণাই পায়, যেমন বালির বাঁধকে জয় করাই ঢেউয়ের স্বভাব। সর্বশেষ ঘটনায় জনতা ক্রুদ্ধ হয়েই ছিল। যখন দেখা গেল যে, ক্যাডার ও দুর্বৃত্তরা পুলিশের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়েছে, উত্তেজিত জনতার একটা অংশের ক্রোধ নিশ্চয়ই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সবাই বিশ্বাস করে ব্লগে যারা আল্লাহ-রাসূল সা: আর ইসলামের চরম অপমান করেছে, শাহবাগের মঞ্চের নায়ক প্রধানত তারাই। তাছাড়া ৫ মে রোববার কিছুসংখ্যক ‘শাহবাগী’ লাঠি-বাঁশ নিয়ে মিছিল করে আসলে উসকানি দিচ্ছিল। সেটা ষাঁড়ের সামনে লাল পতাকা ওড়ানোর মতোই বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাদের কিছু লোক শাহবাগে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশ মারাত্মক ভুল করেছে। এই জনতা তখন পুলিশকে শাহবাগী জনতার পক্ষের বলে ধরে নেয়। তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকার কিংবা পুলিশের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সারা দিন সমাবেশ করে আর স্লোগান দিয়ে মতিঝিলের জনতা নিশ্চয়ই খুবই কান্ত হয়ে পড়েছিল। হাজারে হাজারে তারা মুক্ত আকাশের নিচে শাপলা চত্বরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোর রাতে মাইক বন্ধ করে এবং রাস্তার আলো নিভিয়ে তাদের ওপর গুলি চালানো শুটিং ফ্রম দ্য ব্যাকের (পেছন থেকে গুলি করা) মতোই কাপুরুষোচিত ও ন্যক্কারজনক। বস্তুত এ ঘটনাটা জালিয়ানওয়ালা বাগে ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের মেশিন গানের গুলি চালানোর মতো জঘন্য বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের মানুষ এটা বহুকাল ভুলতে পারবে না। সরকারি ভাষ্য এবং তার সমর্থক সাংবাদিকেরা হতাহতের যে সংখ্যা প্রকাশ করেছেন, বিভিন্ন ব্লগ আর ই-মেইলে দেখা আলোকচিত্রদৃষ্টে সেসব হিসাব প্রকৃত সংখ্যার সামান্য অংশ বলেই মনে হয়েছে। ঢাকার কোনো কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকও কয়েক শ’ লাশের কথাই বলেছেন আমাকে। আমার তখন মনে পড়ে গেল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাত্র চারটি লাশের কারণেই আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস বদলে দিয়েছিলাম, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
অথচ কী প্রয়োজন ছিল এই বীভৎস হত্যালীলার? বর্তমান সরকারের প্রায় শুরু থেকেই আমরা বারবার তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছি। আমরা বলেছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ তো ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্টি জন্য হাজারে হাজারে নিরীহ ধর্মভীরু মুসলমানকে গ্রেফতার, নির্যাতন, সরকারের ভেতরের রাজাকারদের এড়িয়ে গিয়ে বিরোধী দলগুলো থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কয়েকজনকে ফাঁসি দেয়ার বাসনা, বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার ইত্যাদি কারণে সাধারণ মুসলিমরা ক্ষোভ ও ক্রোধে ফুঁসেছিল। যখন ফাঁস হয়ে যায় যে, সরকার দুধকলা দিয়ে শাহবাগে কিছু ধর্মদ্রোহী তরুণকে পুষছে, তখন আর ধৈর্য ধরে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব ছিল না।
এখন কী করতে পারে সরকার
একাধিক কলামে লিখেছিলাম যে, গত বছর হাইকোর্ট ওদের কারো কারো বিরুদ্ধে যে রিট দিয়েছিলেন সেটা কার্যকর না করা সরকারের পক্ষে বিরাট অন্যায় হয়েছে। আরও বলেছিলাম, এদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা হলে জনগণের ক্রোধ প্রশমিত হতে পারে। সরকার আরও বহু অবিবেচনার কাজ করে দেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমানকে অপমানিত করেছেন। ধর্মকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ছেলেখেলা করেছেন বলে জনগণ মনে করছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ এখনো রাজনৈতিক পক্বতা অর্জন করতে শুরু করেননি। লাখ লাখ মানুষ যখন প্রচণ্ড ক্ষোভ জানাচ্ছে, তখন সংবাদ সম্মেলনে তার হুমকি-ধমকি এবং বাক্য চয়নের অসংযম নিশ্চয়ই জনতাকে উসকানি দিয়েছে।
দেশের অন্য শহর-নগরগুলোতে, এমনকি পল্লী বাংলাতেও যেসব সমাবেশ প্রতিবাদ ইত্যাদি হবে সরকার কি শাপলা চত্বরের মতো শুট ফ্রম দ্য ব্যাক করে সেগুলো দলন করতে পারবে? ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকাকে দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। এবার যদি তারা সচিবালয় ও গণভবনকে দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকার তাহলে কী করবে?
দেশকে বর্তমান নৈরাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনার যোগ্যতা, বিজ্ঞতা, ক্ষমতা কিংবা শক্তি বর্তমান সরকারের অবশিষ্ট আছে কি? প্রধান বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসনের সামর্থ্য তাদের নেই। সেজন্য বিরোধী দল গোড়া থেকে যে মূল্য দাবি করে এসেছে, সেটা কোনো মতেই চড়ামূল্য নয়। গোড়া থেকেই তাদের দাবি, একটা নির্দলীয় সরকারের অধীনে মুক্ত ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন। সরকারের ভয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের আবার ক্ষমতা পাওয়ার আশা নেই। তারা আরও জানে যে, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমানেও তারা ক্ষমতায় থাকত না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে, এতে বেশি দিন ক্ষমতায় আসীন থাকা এ সরকারের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। শাপলা চত্বরে ৫ মে রাতে ও ছয় মে ভোরে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। তাদের বয়ানে এবং লোকমুখে ঘুরেফিরে সে সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যাবে। এই সরকারকে তখন কেউ সহ্য করতে রাজি হবে কি?
(লন্ডন, ০৬.০৫.১৩)
serajurrahman@btinternet.com